আতিকুর রহমান মানিক

গত কয়েকবছরের পরিসংখ্যানে ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম স্হানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। অন্যভাবে একে চ্যাম্পিয়নশীপও বলা যায়। বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। রূপালী ইলিশ রক্ষা, এর প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরীর জন্য বাংলাদেশে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে প্রায় একদশক আগে থেকেই। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে প্রজনন মৌসূমে মা ইলিশ রক্ষা ও ডিম ছাড়ার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা, নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা সংরক্ষন কার্যক্রম ও সারাবছর নদ-নদী সাগর মোহনায় নিষিদ্ধ জাল জব্দকরাসহ আরো ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর ফল আজ হাতের মুঠোয়৷ দেশে ব্যাপকহারে বেড়েছে রূপালী ইলিশের উৎপাদন ও আহরন।
প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় আজ থেকে দেশব্যাপী শুরু হচ্ছে জাটকা সংরক্ষন সপ্তাহ – ২০১৯। আজকের জাটকা আগামীর পূর্নাঙ্গ ইলিশ।

‘কোনো জাল ফেলব না, জাটকা ইলিশ ধরব না’ এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আজ ১৬ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত দেশব্যাপী জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদযাপিত হবে। এ উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্রোড়পত্র প্রকাশ, সংবাদ সম্মেলন, কর্মশালা ও ভিডিও প্রদর্শনী ইত্যাদি।

ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাটকা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে বিষয়টিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়া এ সপ্তাহের মূল উদ্দেশ্য। জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের এবারকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মেঘনাবিধৌত ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায় অনুষ্ঠিত হবে।
ইলিশের ডিম পরিস্ফুটনের মাধ্যমে উৎপাদিত বাচ্চাকে ‘জাটকা’ (১০ ইঞ্চি/২৫ সেন্টিমিটারের নিচে) বলা হয়। জাটকা নদ-নদীতে বিচরণ করে। তখন জেলেরা নির্বিচারে জাটকা আহরণ করতে চায়। এভাবে নির্বিচারে জাটকা ধরা হলে ইলিশ উৎপাদন ও আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ জাটকা হল ইলিশের নতুন প্রজন্মের প্রবেশন স্তর।

১ নভেম্বর থেকে ৩১ জুন পর্যন্ত জাটকা ধরা, বিপণন, পরিবহন ও মজুদ বন্ধ থাকে। আইন অমান্যকারী কমপক্ষে ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ইলিশের জীবনচক্র বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনা পানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে চলে আসে। একটি ইলিশ ৩-২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরে আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়।

ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠা পানির দিকে অভিপ্রায়ণ করে। ইলিশ সারা বছরই কম-বেশি ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে এরা প্রধানত ডিম ছাড়ে।

এ জন্য গত বছর (২০১৮) মা ইলিশ সুরক্ষায় আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগের ৪ দিন এবং পরের ১৭ দিন (৪+১+১৭) অর্থাৎ ২২ দিন (৭-২৮ অক্টোবর) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখা হয়।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যমতে, এ সময় প্রজননক্ষম মা ইলিশের হার ছিল ৯৩ ভাগ এবং এর মধ্যে ৪৮ ভাগ পরিপক্ব মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে। ইন্সটিটিউট পরিচালিত গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী গত বছর ২২ দিন মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকরণের ফলে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। এতে ৫০ ভাগ ডিমের সাফল্যজনক পরিস্ফুটন হলে এবং এর ১০ ভাগ বেঁচে থাকলে ৩৫ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে গবেষকরা মনে করছেন।

ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে দেশে ইলিশের ছয়টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মধ্যে মেঘনা নদী, শাহাবাজপুর চ্যানেল, তেঁতুলিয়া নদী, পদ্মা নদী এবং বরিশাল জেলার সদর, হিজলা এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার কালাবদর নদী, গজারিয়া ও মেঘনা নদীতে (৮২ কিলোমিটার অংশে) মার্চ-এপ্রিল মাসে মাছ ধরা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট তিন প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে দুটি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারা জীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর একটি মিঠা পানি ও লোনা পানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ স্রোতের বিপরীতে দৈনিক ৭০ কিলোমিটার অভিপ্রায়ণ করতে পারে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়।

দেশগুলো হচ্ছে : বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের ৭০-৭৫ ভাগ বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত।

ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া অপর ১০টি দেশেই ইলিশ উৎপাদন কমেছে। সুষ্ঠু ও সঠিক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল বাস্তবায়নের কারণে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উৎপাদন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয়, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য অধিদফতর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টন। ২০১৭-১৮ সালে তা ৫.১৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ১০ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ, যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য।

ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসাবে ভূমিকা পালন করছে।