আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:

রাঙামাটি জেলায় এডিবি’র অর্থায়নে এলজিইডির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিয়ে সরকারী কয়েকটি অফিসসহ স্থানীয় স্টেক হোল্ডার মধ্যে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের সড়কের কাজ বন্ধের নির্দেশনা জারি করেছে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ। এদিকে এডিবি’র কার্যক্রমে কাগজপত্রের সাথে বাস্তবতার মিল না থাকায় এধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্পের মাধ্যমে বিপুল পরিমান টাকা আত্মসাতের মানসিকতার প্রকল্প তৈরি অভিযোগ তুলেছে স্থানীয়রা। ইতিমধ্যেই সরকারী-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সরেজমিনে এর সত্যতাও মিলেছে বলে জানাগেছে।

খোঁজ নিয়ে পাওয়া তথ্যে দেখাগেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প ২য় পর্যায়(আউটপুট-বি:রুরাল রোডস কম্পোনেন্ট) (২য় সংশোধিত) এই প্রকল্পটি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এডিবি’র অর্থায়নে এলজিইডি কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে (সিএইচটিআরডিপি-২) এর আওতায় রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় একটি সড়ক তৈরির কাজ চলছে।

উপজেলা সদরের মারিশ্যা বাজার হয়ে মাইনীমুখ বাজার ভায়া বাবু পাড়া বটতলী ও দক্ষিণ সরোয়াতলীতে এই রাস্তার কাজটি বাস্তবায়ন করছে বান্দরবানের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ইউটি মং, মাধ্যম পাড়া বান্দরবান নামক প্রতিষ্ঠান। এই সড়ক নির্মাণ কাজটি বাস্তবায়ন করা সময় চলমান কাজের স্থান সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সম্পত্তি হওয়া সত্বেও বনবিভাগের কাছ থেকে কোনো প্রকার অনাপত্তি গ্রহণ করেনি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এপ্রেক্ষিতে উক্ত কাজ বন্ধে বনবিভাগের পক্ষ থেকে কয়েকটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

চলতি মাসের ৩/২/২০১৯ইং তারিখে উত্তর বনবিভাগ থেকে পত্র নং : ২২.০১.৮৪০০.৮৮৫.০৮.০১.১৯.২৯৪ এর মাধ্যমে প্রেরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়, বিশাল এলাকাজুড়ে কাছালং সংরক্ষিত বনভূমি বিস্তৃত। অবস্থানদৃষ্টে উল্লেখিত রাস্তাটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল তথা পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এর অভ্যন্তরে অবস্থিত বলিয়া প্রতিয়মান হয়েছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে কোনো প্রকার অনাপত্তি পত্র সংগ্রহ ছাড়াই এই ধরনের কাজ করা মোটেও উচিত হয়নি বলেও জানিয়েছেন একজন বন কর্মকর্তা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ সফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এই পত্রে সূত্র (ক) রেঞ্জ কর্মকর্তা শিশক রেঞ্জের পত্র নং-২২.০১.৮৪০৭.৯০৪.১১.০০১.১৯.৪২, তারিখঃ ৩১/০১/২০১৯ইং এবং (খ) রেঞ্জ কর্মকর্তা পাবলাখালী রেঞ্জের পত্র নং-২২.০১.৮৪০৭.৯০৪.১১.০০১.১৯.৪৯ তারিখঃ ৩১/০১/২০১৯ইং এর বরাত দিয়ে জানানো হয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পত্র নং-মপবি/জেপ্র-৪/২/(২৩)৯৭-২০০২(অংশ)৫৩৮ তারিখ: ৯/০২/২০০২ ইং মূলে বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন হলে রাস্তা নির্মাণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট্য প্রকল্পের পিসিপি/পিপি তৈরির প্রাক্কালে বন অধিদপ্তর কিংবা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র/ অনাপত্তি গ্রহণের নির্দেশনা রয়েছে। সম্প্রতি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২৯ মার্চ ২০১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত ৩২ তম সভায়ও অনুরূপ সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। এছাড়াও সংবিধানে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন শিরোনামে (১৮)ক অনুচ্ছেদে সংযোজন করা হয়েছে যে “রাষ্ট্র বর্তমানও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করা করিবেন”। এমতাবস্থায় মারিশ্য বাজার (উপজেলা সদর) মাইনীমুখ বাজার ভায়া বাবু পাড়া বটতলী ও দক্ষিণ সরোয়াতলী রাস্তার কাজ যৌথ জরিপের মাধ্যমে সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত উক্ত রাস্তার কাজ বন্ধের অনুরোধ জানানো হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের পক্ষ থেকে।

এদিকে বনবিভাগের কাছ থেকে এ ধরনের একটি অভিযোগ উত্থাপিতের পর বিষয়টি আবারো রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও উঠে আসে। সভায় জানানো হয়, এই ধরনের একটি ১৪ কিলো কিলোমিটার একটি রাস্তার কাজ করা হচ্ছে কার স্বার্থে এবং বনবিভাগের সংরক্ষিত ভূমি ব্যবহার অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে কোনো প্রকার অনাপত্তি ছাড়াই। প্রশ্ন উত্থাপন করে শৃঙ্খলা সভায় এলজিইডির প্রতিনিধির কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়। এসময় সভায় উপস্থিত এলজিইডির প্রতিনিধি বিষয়টি সম্পর্কে নিজে অবগত নন বলে জানান। এই বিষয়ে তার উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষ জানবেন বলে জানালে সভায় এ বিষয়টি নোটেড করতে বলা হয়।

এদিকে, আইন শৃঙ্খলা সভায় এই বিষয়টি উঠে আসার পর পুরো জেলা জুড়ে বিষয় চাউর হয়। স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী অফিস, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনাসমালোচনা শুরু হয়।

অবশেষে বনবিভাগ ও জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে আলোচনা-সমালোচনা ও পত্রের আলোকে অবশেষে উক্ত কাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে পত্র দিয়ে বাস্তাবায়ন বন্ধ রাখতে সংশ্লিষ্ট্য ঠিকাদারকে পত্রের মাধ্যমে আদেশ দিয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এলজিইডি কর্তৃপক্ষ।

গত ১৩/০২/২০১৯ইং তারিখে স্মারক নং-৪৬.০২.৮৪০০.০০০.১৪.০১৪.২০১৭-১০৪৪ এর মাধ্যমে জানানো হয়, উপযুক্ত বিষয়ের আলোকে জানানো যাইতেছে যে, বর্নিত সড়কটি মারিশ্যা মৌজা, বাঘাইছড়ি মৌজা, সারোয়াতলী মৌজা তিনটি মৌজায় অবস্থিত। উক্ত সড়কের কিছু অংশ সংরক্ষিত বন এলাকায় অতিক্রম করায় বন বিভাগ হতে আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। এমতাবস্থায় উপজেলা প্রকৌশলী বাঘাইছড়ির সহিত পরামর্শ করে সড়কের সংরক্ষিত বনাঞ্চল অংশের উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ রাখার জন্যে বলা হয়েছে।

রাঙামাটিস্থ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ইব্রাহিম খলিল কর্তৃক স্বাক্ষরিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ইউটি মংকে দেওয়া এই পত্রটি অতীব জরুরী বলেও উল্লেখ করা হয়েছে পত্রে।

এই প্রকল্পটি রাঙামাটির জেলা অফিসের তত্বাবধানে বাঘাইছড়ি উপজেলা এলজিইডি কর্তৃপক্ষ নিয়োগকৃত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে।

এদিকে বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্র ও স্থানীয়দের মাধ্যমে জানাগেছে, দাতা সংস্থা এডিবি’র অর্থায়নে এই প্রকল্পটি বিগত প্রায় ৮ থেকে ১০ সময়কাল পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে এধরনের উন্নয়ন কাজ হয়ে আসছে। বিতর্ক উঠা উক্ত সড়কটি এই প্রকল্পের শুরুর যে প্রস্তাবনা সেটিতে উল্লেখ নেই। পরবর্তীকালে বিশেষ কারনে এটি সংযোজন করা হয়েছে তাও মাত্র একটি লাইনের মাধ্যমে। উক্ত প্রকল্পের প্রোপজড স্কিম ডিটেইলস শীটেই শুধুমাত্র ইনক্লোডিং ওয়ান লিংক রোড এই শব্দটি লাগানো হয়েছে। এছাড়া উক্ত প্রকল্পের অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই করে এধরনের লিংক রোডের তথ্য পাওয়া যায়নি বলে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা ও একজন ইউপি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। এদিকে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় উক্ত প্রকল্পটি কোথায় বাস্তবায়ন হবে এবং একুইজিশনকৃত জায়গার মালিক, সংশ্লিষ্ট্য সরকারী প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্টেক হোল্ডার কাছ থেকে অনাপত্তি গ্রহণের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্বেও কেন বনবিভাগ থেকে অনাপত্তি পত্র নেওয়া হয়নি? এমন প্রশ্ন করা হলে রাঙামাটি এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ইব্রাহিম খলিল জানিয়েছেন, এটা আমাদের বিষয়নয়। এটা প্রকল্প পরিচালকের কাজ। এছাড়া আমাদের ঢাকা হেড অফিস থেকেই আমাদেরকে বাস্তবায়নের জন্যে অর্থ বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।

এদিকে বহুল আলোচিত এই প্রকল্পটিতে সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। একটি সূত্র জানিয়েছে, এডিবির মাধ্যমে যে প্রকল্প পাশ করা হয়েছে সেটিতে সংরক্ষিত বনের ভেতরের সড়কটির কথা উল্লেখ ছিলোনা। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ বরাদ্ধ এনে সেটি অন্যস্থানে বিশেষ কারনে ব্যক্তি বিশেষের সুবিধার লক্ষ্যেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছিলো। এদিকের এডিবির এই ধরনের প্রকল্পকে হাওয়াই প্রকল্প হিসেবে মন্তব্য করে মাইনী-মারিশ্যার অন্যতম সংযোগস্থল আমতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী।

এদিকে যেস্থান দিয়ে এই সড়কটি হচ্ছে সেখানে সুবিধাভোগীর সংখ্যা খুবই নগন্য এবং মাত্র কয়েকটি পরিবারের বসবাস। স্থানীয় জনসাধারনের চলাচলের দরকার এমন স্থানকে বাদ দিয়ে জনমানবহীন স্থান দিয়ে এই ধরনের কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে কার স্বার্থে এই প্রশ্ন এখন প্রশাসনসহ সকল স্তরের স্থানীয় বাসিন্দাদের।