তানভিরুল মিরাজ রিপন :

শোক: ৭০ টি বাংলা ভাষাভাষী মগজ,মন,ঠোঁটের, মান,অভিমান আমাদের জীবন্ত মানুষগুলোর সামনে পুড়ে ছারখার হলো তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। ভাষার জন্য প্রান দিয়েছেন যারা, যারা মিছিল মিটিং করেছেন তারা প্রত্যেকে আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্যই প্রান দিয়েছেন। তাদের জন্য শ্রদ্ধা।

ভাষা প্রবহমান। এক সময় বাংলা ভাষাভাষী লোকেদের কোনো নিজস্ব ভূ-খন্ড ছিলো না। ক্রমে ভাষার সভ্যতায় বাংলা ভাষাভাষী লোকেদের সমাগম ঘটে এই অঞ্চলে। ইতিহাস ঐতিহ্যের আদি সময় থেকে এই অঞ্চলের বিভিন্ন নাম ছিলো,এখন সেটি বাংলা নামে পরিচিত। ভাষার শুরুর দিক থেকে বাংলা ভাষার লিখিত রূপ এসেছে এমন নয়। প্রতিটি ভাষার একটি মৌখিক রূপ থেকে ভাষা সংরক্ষণ ও নিয়ম নীতির প্রয়োজনে শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যাকরণের প্রয়োজন। আগেও বলেছি ভাষা প্রবহমান। আমরা যা কথা বলি আমরা তা দেখি,তাই কল্পনা করতে সক্ষম। যা আমাদের ভাষা নয়,যা আমরা আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না তা আমরা কল্পনা বা চিত্রকল্পে আনতে পারি না।

ভূগাঠনিক, জলবায়ু ও আবহাওয়াগত প্রথার বৈচিত্র্যময়তার কারনে প্রতিটি ভূ-খন্ডে ভাষা বৈচিত্রতা দেখতে পাওয়া যায়। মতান্তরে ৫০ মাইল পর পর ভাষার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তবে ভাষার পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও বাক্য প্রকাশের অনুভূতি সর্বক্ষেত্রে এক। ভূ-প্রকৃতিগত ভাবে শ্বাস প্রশ্বাসের, শব্দ উচ্চারণে ধীর,দ্রুত বিষয়টি লক্ষ্যনীয়।

আমরা নৃ-তাত্বিকভাবে বাঙালি, সাঁওতালি,চাকমা,মারমা,ত্রিপুরা,রাখাইন হতে পারি কিন্তু রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশী। এই বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রত্যেকে জাতীয়তাবাদের প্রাসঙ্গিকতায় প্রত্যেকে বাঙালি।অঞ্চল ও নৃতাত্ত্বিক জাতি বৈশিষ্ট্যের কারনে এখানে ভাষা বৈচিত্র্যকে আমরা বলতে পারি উপভাষা কেন্দ্রীক বৈচিত্র্যতা। জনপদ, জীবন যাপন এবং দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ীক লেনাদেনার কারনে ভাষার মিশ্রন ও বিচিত্রতা আমরা দেখতে পায়।

চট্টগ্রাম, ঢাকা,সিলেট এবং আরো অঞ্চল ভেদে আমাদের যে ভাষা পার্থক্য রয়েছে এটি মাত্রই স্বাভাবিকতা। আমাদের প্রত্যেকেরই অঞ্চল ভিত্তিক জন্ম পরিচয় রয়েছে। এই অঞ্চল ভিত্তিক জন্ম পরিচয়টা আমাদের প্রত্যেক মানব জাতির স্বাভাবিকতা।

রাঙামাটির চাকমা সার্কেল রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়ের রাজ নিমন্ত্রণে গতবছরের সেপ্টম্বরে গিয়েছিলাম রাঙামাটি রাজবাড়ীতে,কথা এবং বিতর্কের প্রাসঙ্গিকতায় “স্যাটেলার” শব্দটি বিতর্কে ব্যবহারে দুজনে নারাজ হলেও। বাংলা ভাষায় তিনি অভিবাসী শব্দটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ পাচ্ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিলো, আপনি এই ভূ-খন্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। এবং এখানে কখনো অন্যান্য জাতিগোষ্টী ছিলো না। কিন্তু আপনি আপনার সমাজ সংস্কৃতির সম্পূর্ণটুকু পাঠ ও পালন যদি করতে পারেন তাহলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সংবিধান ন্যায় সঙ্গত যৌক্তিকতার কারনে আপনার সাথে কোনো রকম অন্যায় করছে না।তবে বলে রাখা উচিত যে, ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে যা আছে সব বাংলাদেশের, নৃ-তাত্বিকভাবে আমরা ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশে। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত পরিচয়ে আপনাকে বাংলাদেশী বলা হচ্ছে। আপনার জাতিগত পরিচয়ে বাঙালি বলা হচ্ছে না(১)। বিতর্কের প্রাসঙ্গিকতায় আমরা মতপার্থক্যের স্বাভাবিকতা ভিত্তিতে অনেক গুলো বিষয়ে কথা বলেছিলাম।প্রিয় পাঠক প্রসঙ্গটা ভিন্ন।সংযুক্তিটা এখানে,“ বাঙালি জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা হলো তারা এ দেশের অন্য নৃ-গোষ্ঠীর স্বতন্ত্রতা বুঝতে পারেনি। আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হলো একেবারে ধর্মীয়। এখানে তারা অন্য নৃ-গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত দূরে থাকে তারা কেবল মুসলিম ধর্মের সংকীর্ণ চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত যা বাঙালির অন্য ধর্মাবলম্বিদের ও নৃ-গোষ্ঠী বাদ দেয়”। (২)

বাংলার ইতিহাস সংরক্ষণ ও সম্মান প্রদর্শনে আমরা কখনো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় না।ভাষার প্রতি আমরা প্রত্যেকে সচেতন। বাংলাদেশে শতকরা ৭৬.৬১% জনসংখ্যা এখনো গ্রামে কিংবা মফস্বল শহরে বসবাস করে(৩) ।জীবন মানের উন্নতি বৃদ্ধিতে লোকসংখ্যা নেহায়েত কম না। তাদের মাত্র ২% শতাংশ লোক বাংলা ভাষার সাথে বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলছে।শহরের অধিকাংশ জনসংখ্যা যে বাংলা ভাষার সাথে অন্যান্য ভাষার মিশ্রনে কথা বলছে তা নয়।বলছে তবে তার সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে ভাষা সচেতনতা আছে বলে, ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে আমরা অবিহিত ও অবগত করছি। সুতরাং নূতন প্রজন্ম ইতিহাসের প্রতি সবসময় দ্বায়বদ্ধ। দ্বায়বদ্ধতার কারনে শাহবাগের মতো বিশাল আন্দোলন,নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে তারা প্রত্যেকে আমরা ইতিহাসকে মডেল হিসেবে নিয়ে এগিয়েছি ।সুতরাং নূতন প্রজন্মের ভাষা ও ইতিহাসের প্রতি দ্বায়বদ্ধতা আছে। তবে,তবে এটি ঠিক যে, যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে তারা ব্যান্ড মিউজিকের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিভক্তির কারণে এমনটি হয়েছে। কিন্তু এর জন্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না। যারা দেশের বাইরে যাচ্ছে তারা বেশির ভাগই ভালো করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের অবদান কম কৃতিত্বের কথা নয়। কিন্তু যারা বিদেশে গিয়ে দেশের প্রতি আগ্রহ একবারে হারিয়ে ফেলছে তাদের নিয়ে আমাদের ভাববার রয়েছে। তরুণদের মধ্যে যারা দেশের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে তাদের অসন্তোষ দেখাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র তার কারণ অনুসন্ধান করে তা সমাধানের উদ্যোগ নেবে।(৪)

আমাদের প্রত্যেকের বাংলা প্রমিত উচ্চারণ করে কথা বলা ফরজ নয়।মনের কথা মুখে প্রকাশ করতে পারলেই ভাষার ব্যবহার স্বাচ্ছন্দতা। কথার শুদ্ধ উচ্চারণ একটি আগ্রহ নির্ভর পাঠ। অঞ্চল ভেদে আমাদের শব্দ উচ্চারণগত পার্থক্য রয়ে যাবে। ২০১৮ এর সেপ্টেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম ডিবেট ফোরাম আন্তঃকলেজ বিতর্কের আয়োজন করেছিলেন,বিতর্কে আমি অতিথি এবং বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। ভরা মজলিসে প্রত্যেকে বিতর্ক করছে।মার্কশীটে ৫ নম্বর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো শূদ্ধ উচ্চারণের জন্য। বিতর্ক শেষে আমি তাদের উদ্দেশ্য বলেছিলাম বিতর্ক এবং ভাষা দুটোই আমার সৃষ্টি নই। বিতর্ক হলো সৃষ্টি মানুষের ভাষা ভিত্তিক যজ্ঞ। সুতরাং এখানে নীতি নির্ধারনী থাকা উচিত তবে কঠিন কিছু নয়। বৈচিত্র্যতা যে বিশ্বাস করে না সে উগ্র,নয়তো মানসিক ভারসাম্যহীন ভয়ংকর রোগে ভোগা রোগী।৫০ মাইল পর পর যখন ভাষার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, ভূ-প্রকৃতি,খাদ্যভাস যেহেতু মানুষের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে এগুলো সাথে ভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ার কারনে শূদ্ধ উচ্চারণের ক্ষেত্রে পাণ্ডিত্য জাহিরতা না দেখিয়ে সকলকে বিতর্কটা সহজ আমি করে দিয়েছি যার কারন আমি প্রত্যেক বিতার্কিককে শূদ্ধ উচ্চারণে ৫ নম্বর দিয়েই দিয়েছি।

ইংরেজি ভাষাকে যে বা যারা ইংরেজদের মতো করে বলতে চায়, চান এবং ওদের ধাঁচে না বলতে পারাকে অশুদ্ধ, ভুল বলে নাকচ করে দেন তাদের জন্য আমার অভিজ্ঞতা সংযুক্তি,

ডেভিড এইচ মোল্ড, আমেরিকার ওহিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক। সাউদ এশিয়ান ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম নিয়েও কাজ করেন ভদ্র লোক। বেশ কয়েকটি খ্যাতিমান পুরস্কারও তার ঝুলিতে আছে। তার সাথে ৩০ মিনিটের একটা ডিবেট হচ্ছিলো,প্রায় শেষের দিকে উনি আমার একটা শব্দ উচ্চারণ বুঝতে পারেনি Peace(শান্তি) উনি মনে করেছিলেন আমি খন্ড বুঝাচ্ছিলাম। প্রায় ৬০ জন মতো অডিয়েন্স সেদিন হাসছিলো আমার উচ্চারণ শুনে। আমার এতে লজ্জিত বা অপমানিত মনেহয়নি। কারন আমি বাংলায় ভালোবাসি,বাংলাকে ভালোবাসি।