এম, রিদুয়ানুল হক :
এডুকেয়ার, এডুচেয়ার ও এডুকেটাম এই তিনটি শব্দের সাথে যাঁরা উৎপ্রোতভাবে জড়িত, তাঁদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যতসব আইন-কানুন। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক জাতিরা কোনো মতেই টানা হিঁচড়ে করে তাঁদের সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও কষ্টের মাঝে আজ শিক্ষকরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই মাথা টুঁটি ধরে জোর করে চেপে রাখা হয়েছে পুরো দেশে। সামান্য বেতনে চাকুরি নিতে গিয়ে শিক্ষদের বহন করতে হয়েছে কয়েক লক্ষ কালো হাতের টাকা! তাঁদের আশা ছিল, টাকা দিয়ে চাকুরি নিয়েছি, শান্তি হয়তঃ পাবোই। কিন্তু সরকারের যতসব আইনের চাপে আজ শিক্ষকরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, চোখের ঘুম পর্যন্ত হারাম হয়ে গেছে।

কিছু হলেই শিক্ষকদের উপর চালানো হয় অভিযান। আর আসল অপরাধীরা নাকে সরিষার তেল দিয়ে আরামে ঘুমায়। তারপরও শিক্ষক জাতিরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য এতো বেশি যে, যা ক্যালকুলেটর দিয়ে হয়তঃ হিসেব করতে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যাবে। অন্যান্য পেশার সাথে শিক্ষকদের পেশা একটু ভিন্ন ধাচের। অন্যসব পেশায় কম বেশি ঘুষ লেনদেন হলেও, শিক্ষকদের এই সুযোগটাও নেই। এটি নেই বলে আজ শিক্ষকরা নৈতিকতা ঠিক রেখে কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন।

তবে শিক্ষক জাতিরা তাঁদের নৈতিকতা বজায় রাখতে গিয়ে প্রতিমুহুর্তে প্রশাসনের বিষ নজরে পড়ছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কয়েকদিন পূর্বে, বিবিসিতে শিক্ষকদের বতন বৈষম্য ও কোচিং বাণিজ্য সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পড়েছি। যেখানে শিক্ষকদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ বলে অভিহিত করেছেন। তবে সেখানে কোচিং বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে যে তথ্যটি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যকে দায়ি করা হয়েছে। আর একজন শিক্ষক যে বেতন পান, তাতে সংসার তো দূরের কথা নিজে চলতেও মহা কষ্টে পড়ে যায়। যার কারণে শিক্ষকরা অতিরিক্ত আয়ের জন্য কোচিং করতে বাধ্য হচ্ছে। তাহলে কোচিং করা করা কি অন্যায়? যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য পেশার যারা ভদ্র চাকুরীজীবী আছেন তারা কেন অতিরিক্ত আয়ের জন্য পথ তৈরি করেন? উত্তর দেয়ার অনেক পন্থা থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অন্যা পথ বের করা অন্যায় কেন হবে! অন্যায় হলে সবার জন্য হবে, শুধু শিক্ষকদের ঘাড়ে অন্যায়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া কি সহজ সমাধান!

আমি কিন্তু কোচিং এর পক্ষে নিয়ে কথা বলছি না, বলছি সম আইনের কথা। সবার জন্য সমান আইন না করে শুধুমাত্র শিক্ষকদের ঘাড়ে আইনের বোঝা চাপিয়ে দিবেন তা তো মেনে নেয়া যায় না। অন্য পেশার লোক যদি অফিস টাইমের বাইরে নিজের ব্যক্তিগত কাজ করে অতিরিক্ত আয় করতে পারেন তাহলে শিক্ষক জাতিরা কি অপরাধ করলো? হয়তঃ বলতে পারেন শিক্ষকরা শ্রেষ্ঠ জাতি। তাই তাঁরা কোচিং করতে পারবেন না। ভালো কথা! তাহলে প্রশ্ন, শিক্ষকদের বেতন এতো কম কেন? এটার উত্তর কি দিবেন? হয়তঃ উত্তর দিবেন না, যুক্তি দিবেন। আর যুক্তি দিয়ে তো সংসার চালানো যায় না।

সম্প্রতি কোচিং বাণিজ্য বন্ধের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের নীতিমালা অনুযায়ী হঠাৎ প্রজ্ঞাপন জারি করে দিল। এই জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ। তবে এটি বাস্তবায়ন করা কি আদৌ সম্ভব হবে! স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত যতসব আইন-কানুন প্রজ্ঞাপন হিসেবে জারি করা হয়েছে, তার ১০% ও বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় নি। গত বিএনপি সরকারের আমলে পলেথিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করে জোরালো প্রচার করার পরও কোনো কাজের কাজ হয় নি। বরং পলেথিনের ব্যবহার আরো মাত্রাতিরিক্ত বেড়েই চলেছে। এখন কোচিং এর মাত্রাও যদি পলেথিনের মতো হয়ে যায় তাহলে আইন করে লাভ কী?

বর্তমানে যেকোনো পাবলিক পরীক্ষা এলেই প্রশাসন সর্বপ্রথম কোচিং সেন্টারে অভিযান পরিচালনা করে। এবিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযোগ হচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁস হয় কোচিং সেন্টারে! এটি কি হাস্যকর নয়? প্রশ্ন করা হয় সরকারি প্রেসে, আর ফাঁস হয় কোচিং সেন্টারে! এটি, শিক্ষকরা কোনো মতেই মানতে রাজি নন। শিক্ষকদের প্রশ্ন, কোচিং সেন্টারে প্রশ্ন কেন বা কিভাবে আসবে যদি সরকারের কোনো হাত না থাকে? তাহলে কি এটাই বলবো, যত দোষ নন্দ ঘোষ! দোষ করে একজনে, চাপিয়ে দেয়া হয় অপর জনের ওপর। এটা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়।

আবারো বলছি, আমি কোচিং সেন্টারের পক্ষে কথা বলছি না। বলছি শিক্ষকদের স্বাধীনতার কথা। আমাদের দেশে সকল কর্মক্ষেত্রে ওভার টাইম কাজ করলে ওভার টাইমের মজুরি পাওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষকরা ওভার টাইম কাজ করলে মজুরি তো দূরের কথা, বরং আরো বেশি অপমাণিত হতে হয়। যার কারণে শিক্ষকদের পরিবারকে সাজাতে তাঁরা কোচিং করতে বাধ্য হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, কক্সবাজার জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক বলেছেন- শিক্ষকরা স্কুল টাইমে এবং স্কুল ক্যাম্পাসে কোচিং করেন না। তাঁরা কোচিং করেন স্কুল টাইমের বাইরে এবং ক্যাম্পাসের বাইরে। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি- স্কুল টাইমের বাইরে যে কেউ তাঁর ব্যক্তিগত কাজ হিসেবে কোচিং করাতে পারে। এটি তার ব্যক্তিগত অধিকার। তাঁর উপর যেকোনো আইন চাপিয়ে দেয়া গণতান্ত্রিক অধিকারে পড়ে না।

বর্তমানে একটি কথা না বললে হয় না। বর্তমান সরকার শিক্ষকের বেতন অনেক বাড়িছে। শিক্ষকের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে। তাই সরকারকে ধন্যবাদ। অাগের চেয়ে বর্তমানের শিক্ষকরা অনেক স্বচ্ছল। চট্টগ্রামের একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের এক শিক্ষক (নাম গোপন রাখা হয়েছে) বলেছেন- আমার চার ছেলে মেয়ে নিয়ে চট্টগ্রামের চাঁদগাও আবাসিকের একটি বাসায় ভাড়া থাকি। এই চার ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতে গিয়ে বড়ই কষ্টে আছি। কারণ স্কুলে যা বেতন পাই, তা দিয়ে বাসা ভাড়া পর্যন্ত হয় না। যার কারণে স্কুল টাইমের বাইরে কিছু শিক্ষার্থীকে পড়ানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু প্রশাসনের বিষ-নজরে পড়ে এটাও স্থগিত করেছি। এখন কোন উপায়ে সংসারের খরচ বহন করবো বুঝতে পারছি না। তিনি দুঃখ করে বলেছেন- কেন প্রশাসন সরকারের নির্দেশে আমাদের আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করছে? আর আমরা তো অফিস টাইমে ওভারটাইম করছি না। তাহলে কেন আমাদের উপর আইনেন বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে?

এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশিরভাগ এলাকায় কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার সিলগালা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- কোচিং সেন্টার সিলগালা করলে কি প্রশ্ন ফাঁস রোধ হবে? যদি হয় ভালো কথা। আর না হলে বিকল্প কোনো পন্থা বের করা যায় কিনা দেখতে হবে। শুধুমাত্র শিক্ষকের ঘাড়ে আইন চাপিয়ে দেয়া কতটুকু যৌক্তিক! আইন সবার জন্য সমান। তাই সব পেশার ক্ষেত্রে সমান আইন প্রয়োগ করা সময়ের দাবি।

মানুষ গড়ার কারিগর শুধুমাত্র শিক্ষকরাই। শিক্ষকের অধিকার শিক্ষকেই দিতে হবে। না দিলে শুধু শিক্ষক নয়, শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশ রসাতলে যেতে দেরি হবে না। অন্যান্য দেশের মতো শিক্ষকদের মান সম্মান যদি শতভাগ দেয়া না যায় তাহলে তো ৫০% আশা কি করা যায় না? তাও যদি না হয়, তাহলে এতো চাপ কিসের? যথেষ্ট পরিমাণ মান সম্মান দিলে, যথেষ্ট পরিমাণ চাপ সহ্য করা যায়। তবে, মশা মারতে কামান ব্যবহার করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আসুন, শিক্ষককে সম্মান করতে শিখি এবং তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বোঝা নামিয়ে নিতে চেষ্টা করি। কারণ, শিক্ষক শ্রেষ্ঠ সবার।


এম, রিদুয়ানুল হক (এমএ) , শিক্ষক, সংবাদকর্মী ও মানবাধিকার কর্মী

(লেখকের বক্তব্য একান্ত নিজস্ব, সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে সম্পর্কিত নয় -সিবিএন)