ড. আবদুল্লাহ আল মামুন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে এখন সাংবাদিকতা, সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ মুঠোফানের মাধ্যমে অর্ন্তজালে প্রচার করে বহু সাধারণ মানুষও দৈবক্রমে সেলিব্রেটি হয়ে উঠছেন। অজ¯্র লাইক পাওয়া কিংবা পোস্ট ভাইরাল হওয়ার আশায় অনেকে মিথ্যাকে সত্যের সূক্ষ প্রলেপ মেখে প্রচার করছেন। ফটোশপের কারসাজি দিয়ে কেউ কেউ ছবি বিকৃতি করতেও পিছপা হচ্ছেন না। ফটোশপের কেরামতির গুনে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা যাচাই করা ইদানিং পাঠকদের পক্ষে অনেকটা অসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংবাদ কিভাবে লিখতে হয় এবং পরিবেশন করতে হয় – সে কথা নাহয় বাদই দিলাম। নিউজ পোর্টাল কিংবা অর্ন্তজালের প্রযুক্তিগত বিষয়ে নূন্যতম ধারণা নাই – এমন যে কেউ এখন নিউজ পোর্টাল খুলে বসছেন। নিউজ পোর্টালে দেয়া বিজ্ঞাপন থেকে কিছু আয় হবে, সেই স্বপ্নই হয়তো তারা দেখছেন। পত্রিকা চালানোর জ্ঞান যাদের নেই, তারাই হয়ে এখন হয়ে গেছেন সাংবাদিক ও সম্পাদক।

ইদানিং পত্র-পত্রিকা, অন-লাইন সংবাদ পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায় যে হারে মৃত ব্যক্তির ছবি দেয়া হচ্ছে, তা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই ছবিগুলো যারা দিচ্ছেন তারা আর কেউ নন, ওই ব্যক্তিরই খুব কাছের মানুষ। সেদিন আমার পরিচিত একজন তাঁর বন্ধুর সুস্থতা কামনা করে ফেসবুকে দোয়া চেয়েছেন, সঙ্গে মুখে পাইপ ও যন্ত্রপাতি লাগানো বিছানায় অচেতন বন্ধুটির ছবিটিও জুড়ে দিয়েছেন। নীচে একজন মন্তব্য করেছেন, “ভাইয়া, উনিতো গতকাল মারা গেছেন”। দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল আমার। আরেকটি পোষ্টে বিছানায় শায়িত নিজের বাবার সদ্য মৃত ছবি দিয়ে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন আরেকজন। মানুষ কতটুকু কান্ডজ্ঞানহীন হলে এমন করতে পারে, জানি না।

মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষের শেষ মূহূর্তগুলো খুবই ব্যক্তিগত, যা সবার সাথে শেয়ার করা খুবই অন্যায় এবং অমানবিক বলে আমি মনে করি। পৃথিবী থেকে শেষ বিদায় নেওয়ার সময় কে কি অবস্থায় থাকবে. সেটা কারো জানা নেই। অনেকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কিংবা সংঘর্ষে খুন হয়েছে – এমন রক্তমাখা বিকৃত লাশের ছবি দিচ্ছেন অর্ন্তজালে। এ ধরনের কাজ করার আগে আমাদের ভাবতে হবে, এই ছবি দেয়া কি সত্যিই খুব জরুরী? এটা কি কারো উপকারে আসবে? একবার ভেবে দেখুন, এ ধরনের পোষ্ট মানসিক বিকাশ হয়নি এমন কোমলমতি শিশুদের উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে। আমাদের আশে পাশে এমন অনেক মানুষ আছেন আছেন যারা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন কিংবা মানসিক রোগে ভুগছেন। এই ধরনের ছবি তাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতে পারে।

মরদেহের ছবি এভাবে দেয়া হলে মৃত্যু, রক্তপাত ইত্যাদি বিসয়ে মানুষের সংবেদনশীলতা কমে যেতে পারে – এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায়না। এ জন্যই হয়ত এখন রাস্তায় মৃত মানুষের লাশ কিংবা দুর্ঘটনায় আহত মানুষের আর্তনাদ পথচারীদের বিচলিত করেনা। সবাই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চান। অথচ ইলেট্রনিক যুগের আগে আর্ত মানুষের সেবায় কে এগিয়ে যাবে, সে নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা।

দেশ-বিদেশের মান সম্পন্ন গনমাধ্যমের পাতায় এ ধরনের ছবি দেওয়া হয়না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন জনস্বার্থ ও বিপন্ন মানবতার কথা বিবেচনা করে অনেক সময় এ ধরণের ছবি ছাপানো যেতে পারে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় নাপাম বোমার প্রলয়ংকরী আগুন থেকে পলায়নপর ক্রন্দনরত কিছু শিশুর ছবি বিশ^ব্যাপী যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সাহায্য করে। আশির দশকের মাঝামাঝি আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের ছবি বিশ^ মানবতাকে জাগিয়ে তোলে। সঙ্গীত শিল্পী বব জেলডফ ১৯৮৫ সালের ১৩ জুলাই, লন্ডনের উইম্বলী স্টেডিয়ামে আয়োজন করেন বিখ্যাত “লাইভ এইড” কনসার্ট। এই কনসার্টর মাধ্যমে তিনি আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের জন্য প্রায় ২১ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেন। এছাড়া ২০১৬ সালে তুরস্কের পশ্চিম উপক’লে ভেসে উঠা সিরিয়ার শরণার্থী শিশু আইলানের পড়ে থাকা নিথর দেহের ছবি ইউরাপের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে কেবল জার্মানী প্রায় ছয় লক্ষ সিরিয়ান শরনার্থী গ্রহন করে।

ইদানিং রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বহু ছবি গনমাধ্যমে বা সোস্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে পুড়ে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত লাশের ছবি ও ভিডিও বেশী বেশী শেয়ার করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সহানূুভ’তির বদলে মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ অনেকে বিশে^র অন্য জায়গায় ঘটে যাওয়া সহিংসতার ছবিও মিয়ানমারের বলে চালিয়ে দিয়ে ফায়দা লুটতে পারেন।

একজন মৃত মানুষ কিংবা হাসাতালে শয্যাশায়ী মানুষের ছবি ছাপানোর আগে তাঁদের পরিবার থেকে অনুমতি নেয়া আবশ্যক। বিশিষ্ট সংঙ্গীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর হঠাৎ করে ফেসবুকের পাতায় হাসপাতালের হিমাগারে রাখা তাঁর মুখমন্ডলের ছবি দেখে চমকে উঠেছি। খুব কষ্ট হয়েছে দেখে। ছবিটি ফেসবুকের পাতা থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য প্রয়াত বাচ্চুর পরিবার থেকে অনুরোধ করা হয়। সমস্যা হল, কোনো কিছু ভাইরাল হয়ে গেলে অর্ন্তজালের পৃথিবী থেকে সেগুলো আর কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না। মৃত ব্যক্তির প্রিয়জনদের জন্য এটা খুবই কষ্টের। সময়-অসময়ে কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠা মৃত ব্যক্তির ছবি প্রিয়জনদের হৃদয়ে বেদনার হুল ফোটাবে। অর্ন্তগত রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না কোনোদিন। হারানোর ব্যথা জিইয়ে থাকবে বাকীটা জীবন।