ডেস্ক নিউজ:
সাংবাদিক জামাল খাশোগির ব্যাপারে কিছুই জানেন না—সৌদি আরবের বাদশাহ সালমানের এমন মন্তব্যের এক দিনের মাথায় বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগিকে হত্যার কথা স্বীকার করার বিষয়টি বিবেচনা করছে রিয়াদ। গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়লেও খোদ সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো ঘোষণা আসেনি।

এর মধ্যেই গতকাল সৌদি আরব সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। এ সফরে খাশোগি ইস্যুতে ‘পূর্ণাঙ্গ’ তদন্তের ব্যাপারে সৌদি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে তাঁর ঐকমত্য হয়েছে বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। আজ বুধবার পম্পেওর তুরস্কে যাওয়ার কথা।

গত ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ খাশোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে—তুরস্কের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরবের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এমনকি সৌদি আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন এরই মধ্যে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বের নামকরা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আগামী মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার রিয়াদে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’ শীর্ষক সম্মেলন। খাশোগি ইস্যুর জেরে এ সম্মেলন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন জেপিমর্গ্যান চেজ, ফোর্ড, ব্ল্যাকরক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি, ক্রেডিট সুইসের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিরা।

রিয়াদে অনুষ্ঠেয় সম্মেলন বর্জনের মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ নেই। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি যৌথ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, খাশোগির নিখোঁজ হওয়াকে তারা ‘চরম গুরুত্বের’ সঙ্গে নিয়েছে এবং এ ব্যাপারে তারা ‘বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত’ পরিচালনার দাবি জানিয়েছে।

এদিকে গত সোমবার ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে এক দফা তদন্ত চালানোর পর তুরস্কের তদন্তকারীরা এবার কনসাল জেনারেলের বাসভবনে অনুসন্ধান চালানোর কথা ভাবছেন। তুরস্কের এক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, গতকাল মঙ্গলবারই ওই অনুসন্ধান চালানোর কথা। এ ছাড়া গত সোমবারের তদন্তের ব্যাপারে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান জানান, তাঁর দেশের তদন্তকারীরা সৌদি কনস্যুলেটে ‘বিষাক্ত’ পদার্থের অস্তিত্ব খুঁজছেন, যা হয়তো রং করে এরই মধ্যে আড়াল করে ফেলা হয়েছে। তার পরও খাশোগি নিখোঁজের ব্যাপারে ‘শিগগির যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা’ পাওয়ার আশা করছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। গত সোমবার সৌদি তদন্তকারীদের পাশাপাশি তুর্কি তদন্তকারীরাও ৯ ঘণ্টা কনস্যুলেটে অভিযান চালান এবং এর ভিত্তিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এসব কথা বলেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নানামুখী কর্মকাণ্ডের মধ্যে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করে, সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর খাশোগিকে হত্যার কথা স্বীকার করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে সৌদি আরব। দুটি সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, সৌদি কর্তৃপক্ষ এমন এক প্রতিবেদন তৈরি করছে, যেটায় বলা হচ্ছে, খাশোগিকে জিজ্ঞাসাবাদ ভুল করে ভিন্ন মোড় নেওয়ার একপর্যায়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁকে জোর করে সৌদি আরবে ফেরানোই ছিল জিজ্ঞাসাবাদের মূল লক্ষ্য—সূত্রের বরাত দিয়ে এমনটিও জানায় সিএনএন। এদিকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, ভুলক্রমে দুর্বৃত্তদের হাতে খাশোগির নিহতের কথা ঘোষণা করা হবে কি না—এমন ভাবনাও সৌদি কর্তৃপক্ষের মাথায় আছে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক পম্পেওর সৌদি আরব সফর এবং সে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর অব্যাহত বৈঠকের মধ্যে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো রিয়াদের এমন ভাবনার খবর জানাল।

পম্পেও গতকাল রিয়াদে বিমানবন্দরে নামলে তাঁকে স্বাগত জানান সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রিয়াদে পৌঁছে পম্পেও দিনভর বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। প্রথমেই সৌদি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে তাঁর আনুমানিক ১৫ মিনিটের এক সংক্ষিপ্ত বৈঠক হয়। এ বৈঠকে সৌদি বাদশাহ খাশোগি ইস্যুতে ‘একটি পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী’ তদন্তের অঙ্গীকার করায় তাঁকে ধন্যবাদ দেন পম্পেও—এমনটা জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নাওয়ার্ট।

সৌদি বাদশাহর সঙ্গে বৈঠকের পর পম্পেও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ৩৫-৪০ মিনিট কথা বলেন। একই দিন তাঁদের এক নৈশভোজে অংশগ্রহণের কথা ছিল। এ ছাড়া সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবেইরের সঙ্গেও পম্পেওর কথা হয়েছে।

এদিকে গত সোমবার শেষবেলায় দেওয়া এক বিবৃতিতে খাশোগির সন্তানরা বাবার ‘হত্যাকাণ্ডের তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক কমিশন’ গঠনের দাবি জানায়। অথচ ৭ অক্টোবরের বিবৃতিতে তারা অভিযোগ করেছিল, তাদের বাবার নিখোঁজের বিষয়টিকে ‘রাজনীতিকীকরণ’ করছে সংবাদমাধ্যমগুলো। বিবৃতিতে তারা এটাও জানিয়েছিল, এ ইস্যুর সমাধানের ব্যাপারে সৌদি কর্তৃপক্ষের ওপর তাদের আস্থা আছে।

খাশোগির নিখোঁজের ব্যাপারে রিয়াদ, আঙ্কারা, ওয়াশিংটনের নানামুখী তৎপরতা এবং খাশোগির স্বজনদের বক্তব্য পরিবর্তনের মধ্যে বক্তব্য এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধানের দিক থেকে। সংস্থাটির মানবাধিকার প্রধান মিচেল বাচেলেত গতকাল দেওয়া বিবৃতিতে রিয়াদের প্রতি আহ্বান জানান, খাশোগি নিখোঁজের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের যেন কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া না হয়।

সৌদি যুবরাজের কট্টর সমালোচক খাশোগি গত ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ। কনস্যুলেট কর্তৃপক্ষের দাবি, সেদিনই খাশোগি কনস্যুলেট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাইরে অপেক্ষমাণ তাঁর বাগদত্তা তাঁকে বের হতে দেখেননি বলে দাবি করেন। ওই দিন ১৫ জন শীর্ষস্থানীয় সৌদি নাগরিক ইস্তাম্বুলে গিয়েছিলেন, যাঁরা খাশোগি হত্যায় জড়িত থাকতে পারেন বলে সন্দেহ তুরস্কের। খাশোগির হত্যার প্রমাণ হিসেবে অডিও-ভিডিও হাতে আছে—এমন দাবিও করেছে তুরস্ক। সূত্র : এএফপি, সিএনএন।