বণিক বার্তা : সম্পদশালীদের বড় অংশের আবাস চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে। ভারত ও হংকংয়েও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সম্পদশালী রয়েছে। দ্রুত বাড়ছে এসব ধনীর সম্পদের পরিমাণ। তবে বাংলাদেশী ধনীদের সম্পদ বাড়ছে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথএক্সের প্রতিবেদন বলছে, গত পাঁচ বছরে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।

নিজস্ব ‘ওয়েলথ অ্যান্ড ইনভেস্টেবল অ্যাসেটস মডেল’ ব্যবহার করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ওয়েলথএক্স। প্রতিষ্ঠানটির নতুন এ মডেলের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মোট সম্পদের আনুমানিক তথ্য পাওয়া যায়। পাশাপাশি সম্পদের মালিকানা ও বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের বিবেচনায় জনসংখ্যার তুলনামূলক একটি চিত্রও এতে উঠে আসে। বৈশ্বিকভাবে সম্পদের এ ধরনের বিশ্লেষণ ছাড়াও শীর্ষ ৭৫টি অর্থনীতির দেশে সম্পদের ব্যাপ্তি ও প্রবৃদ্ধি ওয়েলথএক্সের গবেষণার বিষয়বস্তু।

প্রতিবেদন তৈরিতে দুটি ধাপে তথ্য বিশ্লেষণ করে ওয়েলথএক্স ইনস্টিটিউট। প্রথম ধাপে ইকোনমেট্রিক কৌশল ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পুুঁজিবাজারের আকার, জিডিপি, করহার, আয় ও সঞ্চয়ের তথ্য সংগ্রহ করে তারা। তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পরিসংখ্যান সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষকে।

দ্বিতীয় ধাপে জনপ্রতি সম্পদের পরিমাণ হিসাব করা হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্পদের বণ্টনসংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতি থাকায় সংশ্লিষ্ট দেশে মানুষের আয় বণ্টনের হিসাব বিবেচনায় নেয়া হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কাছে থাকা বিশ্বব্যাপী অত্যধিক সম্পদশালী ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষের তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করা হয়। এতে আর্থিক স্থিতি, কর্মজীবন, ঘনিষ্ঠ সহযোগী, পারিবারিক তথ্য, শিক্ষাজীবন, আগ্রহ, শখসহ সম্পদশালীদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য রয়েছে। পাশাপাশি অর্জিত সম্পদের বিনিয়োগ ও ব্যয়প্রবণতার তথ্যও বিবেচনায় নেয়া হয়। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্পদের প্রকৃত ও গ্রহণযোগ্য চিত্র তুলে ধরে ওয়েলথএক্স।

চলতি মাসে প্রকাশিত ওয়েলথএক্সের ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ধনকুবেরদের সামগ্রিক সম্পদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ধনীদের সম্পদ প্রবৃদ্ধির এ হারের সুবাদে ওয়েলথএক্সের তৈরি তালিকায় শীর্ষ দশের প্রথম স্থানটিই বাংলাদেশের।

দেশে আয়বৈষম্য যে প্রকট হচ্ছে, এটা তারই প্রতিফলন বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আয়বৈষম্য প্রচণ্ডভাবে বাড়ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল একটা ক্ষুদ্র ধনাঢ্য গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে জমছে। ওয়েলথএক্সের প্রতিবেদনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

ওয়েলথএক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধনীদের সম্পদের দ্রুত বৃদ্ধি বিবেচনায় বাংলাদেশের পরই আছে চীন। দেশটিতে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। তালিকার তৃতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনামের ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে থাকা কেনিয়ার ধনীদের সম্পদ বার্ষিক ১১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। পঞ্চম স্থানে থাকা প্রতিবেশী ভারতের ধনীদের সম্পদ স্ফীত হচ্ছে বার্ষিক ১০ দশমিক ৭ শতাংশ হারে।

ধনীদের দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধির তালিকায় ভারতের পরই রয়েছে হংকং। এখানকার ধনীদের সম্পদ বাড়ছে বার্ষিক ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। পরের স্থানগুলোয় থাকা আয়ারল্যান্ডের ধনীদের বার্ষিক সম্পদ বৃদ্ধির হার ৯ দশমিক ১, ইসরায়েলের ৮ দশমিক ৬, পাকিস্তানের ৮ দশমিক ৪ ও যুক্তরাষ্ট্রের ৮ দশমিক ১ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্পদশালী ধনীদের সিংহভাগই চীনের। সম্পদ সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এমন ৩০টি শহরের ২৬টিই চীন, ভারত ও হংকংয়ে। ২০১৭ সালে মোট সম্পদ বৃদ্ধির ৩০ শতাংশই হয়েছে এ দেশগুলোয়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ এসেছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ থেকে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সম্পদের কেন্দ্রীভবন বাড়ছে। সরকারি তথ্য-উপাত্তেই এ প্রবণতা দেখা যায়। এখন বৈশ্বিকভাবেও সে চিত্র উঠে এসেছে। এ গবেষণা যেটা ইঙ্গিত দিচ্ছে তা হলো, রাজস্বনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, মুদ্রানীতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে আরো নজর দেয়া উচিত।

সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন সেখানে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়া বাংলাদেশী ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আজিজ খান। প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস তাদের আগস্ট সংখ্যায় সিঙ্গাপুরের ৫০ শীর্ষ ধনীর যে তালিকা প্রকাশ করেছে, মুহাম্মদ আজিজ খানের অবস্থান সেখানে ৩৪তম। বাংলাদেশী সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যানের মোট সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৯১ কোটি মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ারহোল্ডিংয়ের পাশাপাশি পরিবার, স্টক এক্সচেঞ্জ, বিশ্লেষক ও অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া আর্থিক উপাত্ত ব্যবহার করে তালিকাটি তৈরি করেছে ফোর্বস। পারিবারিক সম্পদও সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।