মোহাম্মদ ইলিয়াছ:
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদ। মুসলমানদের ঘরে বছরে দু‘বার ঈদ আসে। একটা হল ঈদুল ফিতর এবং আরেকটা হল ঈদুল আযহা। এ দু‘টি ধর্মীয় উৎসবই শিক্ষণীয় ও গুরুত্বের দাবিদার। মহান আল্লাহ পাকের কাছে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবের মর্যাদা অবস্থানভেদে পরিলক্ষিত। তবে ঈদে ছোট-বড় সবার জন্য বয়ে আনে আনন্দের ঢেউ। আমরা মুসলিম সমাজ বাহ্যিকভাবে ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কিন্তু উভয় ঈদের গুরুত্ব একটার চেয়ে একটা কোন অংশেই কম নয়। প্রত্যেক ঈদের বহু তাৎপর্য রয়েছে। এ তাৎপর্যের মধ্যে রয়েছে অনেক কিছু শিখার ও জানার। ঈদুল ফিতরের একটি তাৎপর্য হল মানবের ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধনী-গরিবের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার শিক্ষা। অন্যদিকে ঈদুল আযহার তাৎপর্যের মধ্যে রয়েছে মানবের সম্পর্ক। এ ঈদ সৃষ্টির দিন যদি দুম্বার বদলে আল্লাহ পাক মানব কোরবানী দিতে হকুম দিতেন তাহলে কি অবস্থা হত, তা ভেবে দেখেছেন কি? এক কথায় মুসলিমদের মুসলমানিত্বের পরিচয় রয়েছে এ ঈদেই।

ঈদুল আযহার আভিধানিক অর্থ আত্মত্যাগ। ঈদুল আযহা হচ্ছে সৎ পথে জান-মাল কোরবানী দেয়ার উৎসব। মুত্তাকি পরিচয় দেয়ার উৎসব। যার জন্য আমরা একে কোরবানীর ঈদ বলে থাকি। আরবী মাস জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত যে উৎসব পালন করা হয় তা হল ঈদুল আযহা। তবে বেশির ভাগই আলেম-ওলামার মতে জিলহাজ্ব মাসের ১০ তারিখই ঈদুল আযহা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। কোরবানী সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেছেন, কোরবনীর পশুর রক্ত বা গোশত আল্লাহর কাছে ঁেপৗছে না, পোঁছে তোমাদের আদর্শ ও নিষ্ঠা। বর্তমান সমাজে কোরবানীর আদর্শ নিষ্ঠার জন্ম না হওয়ায়তে শুধু গোশত খাওয়ার মধ্যে থেকে গেল ঈদ উৎসব। কোরবানীর গোশত, চামড়া,চামড়া বিক্রির টাকা গরীবের হক। কোরবানীর গোশত তিন ভাগের এক গরীবদের হক। আর কোরবানীর প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে আত্মত্যাগ।আল্লাহ নির্দেশ দিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ:) কে তাঁর আদরের পুত্র হযরত ইসমাইল (আ:) কে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানী দিতে। সাথে সাথে তাঁরা রাজী হয়ে গেলেন। ঘটনার এক পর্যায়ে দেখা গেল, আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইসমাইল (আ:)‘র কোরবানীর পরিবর্তে একটা দুম্বা কোরবানী হল। আল্লাহর এ মহান পরীক্ষায় পিতা-পুত্র সবাই রেহাই পেল।এ ঘটনার কারণে আল্লাহ মুসলমানদের জন্য ঈদুল আযহা ওয়াজিব করে দিলেন।

এ ঘটনা বিশ্লেষণে বুঝা যায়, আল্লাহর বিধানের সামনে সর্বোত ও শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পন করতে হবে। নিজকে বিসর্জন দিতে হবে আল্লাহর রাস্তায়। আল্লাহ কোরান শরীফে বলেছেন, একজন খাঁটি মোমিনের জীবন হবে এরকম যেন, সে ঘোষণা করতে পারে নিশ্চয়ই আমার ইবাদত বন্দেগী, আমার কোরবানী ও জীবনমৃত্যু সবই আল্লাহর হাতে।

কোরবানী আল্লাহ ও রাসুল (স;) এর নির্দেশনাবলী। হাদীস শরীফে এসেছে, কোন ব্যক্তি যদি কোরবানীর নিয়তে পশু কিনে, যেদিন কিনবে সেদিন থেকে কোরবানী করার আগ পর্যন্ত উক্ত পশুর দুধ পান এবং লোমকাটা সম্পূর্ণ হারাম। যদি কেউ ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় হোক দুধ নেয়, তাহলে উক্ত দুধ মিছকিনকে ছদকা হিসেবে দিয়ে দিতে হবে। অন্যদিকে কোরবানীর পশু নিজ হাতে জবেহ করা উত্তম। তবে যে জবেহ করবে এর সাথে কোরবানীওয়ালাকে অবশ্যই পাশে থাকতে হবে। যিনি জবেহ করবেন তাকে এবং উক্ত পশুকেও কেবলামূখী করে রাখা মুস্তাহাব। কোরবানীওয়ালা ব্যক্তি ছাড়া যে বা যারা কোরবানীর পশুকে গলায় ছুরি দেবে তাকে উক্ত পশুর চামড়া বা গোশত দেয়া হারাম। কাঁটাছিঁড়া ব্যাক্তিকে গোশত দেয়া জায়েজ আছে। কোরান শরীফে এসেছে, যে ব্যাক্তি কোরবানী সম্মানের সাথে আদায় করবে তাঁর মধ্যে মুত্তাকির পরিচয় পাওয়া যাবে। অন্য একটি হাদিস শরীফে এসেছে যদি কোন ছোট্ট গ্রামে, যেখানে ঈদের নামাজ কিংবা জুমার নামাজ কোনটাই হবার সম্ভাবনা নেই, সেখানেই জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখের শুরুতে সুবহে সাদিকের পরেই পশুর কোরবানী করা জায়েজ আছে। পবিত্র ঈদুল আযহার আত্মত্যাগের সঠিক শিক্ষা আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। অবশ্যই প্রয়োগ করতে বাস্তব জীবনে।

ঈদুল আযহার নামাজ শেষে শুরু হয় পশু জবাই। যার যার সামর্থ্যানুযায়ী পশু জবাই করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা পরিবেশ সুরক্ষার দিকে খেয়াল রাখি না। পশুর বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে না ফেলে যেখানে-সেখানে ফেলে দিই। ফেলে দেয়া বর্জ্য কুকুর যেখানে-সেখানে নিয়ে যায়। ফেলে দেয়া বর্জ্য থেকে বের হয় দুর্গন্ধ। এ অবস্থায় বিরাজ করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আর দুর্গন্ধে রাস্তায় হাঁটা চলা অস্বস্থীকর হয়ে পড়ে। আমরা যারা কোরবানীর পশু জবাই করব তাদেরকে পরিবেশে সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যার যার এলাকার পরিবেশকে সু-রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। পশু জবাই শেষে পশুর বর্জ্য গর্ত করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। জবাই ও মাংস বন্টনকৃত স্থান ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজবোধে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এদিন অধিক পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগ দিতে পারে। অথবা পশুর কোরবানীওয়ালারা পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগ দিয়ে যার যার পশুর বর্জ্য পরিষ্কার করতে পারেন।

সকলকে মনে রাখতে হবে যার যার পশুর বর্জ্য তাকেই পরিষ্কারের উদ্যেগ নিতে হবে। জবাইয়েরর পর যেন পাওয়া না যায় কোন গন্ধ। না পরিবেশ দুষিত হয়ে এলাকায় রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়বে। পরিবেশ সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। কোরবানীর ঈদ যেন আমাদেরকে সকলকে আত্মত্যাগ ও পরিবেশ সুরক্ষায় নিয়োজিত রাখে।

মোহাম্মদ ইলিয়াছ
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক
আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।
Email: milias08@gmail.com