মোঃ তরিকুল আলম (তারেক)


১. আজ একটা গল্প বলবো “জীবন মৃত্যুর” গল্প।
বেশ কয় বছর আগের ঘটনা আমার বাসার পাশেই মহানগর প্রজেক্ট সেখানে এক ভদ্রলোক মারা গেলেন। আমিও দেখতে গিয়েছিলাম। সেই লোক মারা গিয়েছিলেন বিকেলে। যেহেতু তার আত্বীয় স্বজন ঢাকার বাহিরে থাকে সে কারনেই সিদ্ধান্তু হল পরের দিন সকাল ১১ টায় কবর দেওয়া হবে। এখন সমস্যা হল লাশ যখন গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পড়িয়ে ঘরে রাখা হল তখন।
যে ঘরে আগে তিনি থাকতেন অর্থাৎ বেডরুমে রাখা হল তাকে, আর তাতেই ঘটলো বিপত্তি। উনার ওয়াইফ কোন ভাবেই সে ঘরে থাকবেন না কারন তিনি তার লাশ দেখে ভয় পাচ্ছেন। তাকে কোন অবস্থাতেই সেই ঘরে রাখা গেল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যদি তাকে সে ঘরে রাখা হয় তবে তিনি নিজেও যেন লাশে পরিনত হবেন।
আমিতো অবাক যে মানুষটার সাথে এতো বছর একসাথে সংসার করেছেন সুখ- দু:খের সাথী ছিলেন সেই লোকটাই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এতো পর হয়ে গেলেন কি করে! কেবল সেই লোকটা আর আগের মতো নাক দিয়ে পৃথিবীর অক্সিজেন নিতে পারছেন না তাই। যে লোকটা তার পাশে এতো বছর শুয়ে ছিলেন, ঘুমালে মানুষ অনেকটা মৃত মানুষের মতোই হয়ে যায় অথচ তখন তিনি ভয় পায়নি বরং জরিয়েই শুয়ে ছিলেন। যে লোকটা একসময় তাকে কত আদর সোহাগ করেছেন ভালবেসেছেন যা তার শরীরের প্রতিটি স্থানে ছুঁয়ে আছে। সে নিজেও এই লোকটাকে কত আদর করেছেন, সুখ- দ:খের গল্প করেছেন শীতের সময় হয়তো একই লেপ বা কম্বলে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়েছেন। আজ সেই লোকটাই ভয়ের কারন হয়ে গেছে ভাবা যায়!!

প্রকৃত অর্থে মানুষ মরে গলে সে আর মানুষ থাকে না লাশ হয়ে যায়। মরে যাওয়া মানে লাশের সাথে সবকিছুই হারিয়ে যাওয়া। সব দেনা পাওনা চুকিয়ে যাওয়া।
তবে কি আমরা জীবদ্দশায় ভুল বলি দুটি আত্না একটি প্রান!!

২. আরও একটি ঘটনা বলি তখন আমি স্কুলে নাইন/ টেনে পড়ি আমাদের বাসায় এক ফ্যামিলি ভাড়া থাকতো। তাদের সাথে আমাদের ফ্যামিলি খুব ঘনিষ্ঠ ছিল সেই লোক আমার মা’কে আপা ডাকতো সে হিসাবে আমরা তাকে মামা ডাকতাম। নতুন বিয়ে করে আমাদের এখানে উঠেছেন তার ওয়াইফ কে আমরা মামি ডাকতাম। খুব ভাল ছিল প্রায় সময় আমাদের বাসায় এসে আম্মার সাথে গল্প করতো। বলতে গেলে আমাদের কাছে মামা- মামির মতই মনে হতো কেননা আমাদের মামা- মামি দেশের বাড়ীতে থাকেন। বছর খানেক পর তার একটা ছেলে হল আমরা সে বাচ্চাটাকে খুব আদর করতাম কারন আমাদের বাসায় কোন ছোট বাচ্চা ছিল না। তার বছর দুই পর আমার সেই মামি আর একটি বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেন। আমরা খুব কষ্ট পেলাম মনে হলো নিজের মামি মারা গেছেন। তাদের ছোট বাচ্চাটার জন্য আরও বেশী খারাপ লাগছিল। তার স্বামী অর্থাৎ মামা তার ওয়াইফ মারা যাওয়াতে এতো কষ্ট পেলেন যেন মুহুমুহু মূর্চ্ছা যাচ্ছেন। তার কান্না কোন ভাবেই থামানো যাচ্ছিল না। পূরুষ মানুষ এতো কাঁদতে পারেন তাকেই আমি প্রথম দেখেছিলাম।আমরা তাকে দেখে বুঝলাম তিনি মামিকে ভীষন ভালবাসেন।

তার অবস্থা অনেকটা শরৎচন্দ্রের দেবদাসের মত হয়ে গেল। তিনি হয়তো মদ খাওয়া ধরলেন না কিন্তু দাড়ি কামানো বন্ধ করে দিলেন। তাকে দেখে খুব খারাপ লাগে মনে হয় তার চেয়ে দু:খি মানুষ যেন এ পৃথিবীতে নেই। এভাবে পনের দিন কাটলো মামা দেশের বাড়ীতে বেড়াতে গেলেন । সপ্তাহ খানেক পর তিনি ফিরে এলেন তার শালি’কে বিয়ে করে। শুনে অবাক হয়ে দেখতে গেলাম। নতুন মামি লাল শাড়ি ঘোমটা দিয়ে বসে আছে আর আমার দেবদাস মামার বিষণ্ণতা কর্পূরের মত উড়ে গেছে। তার হাস্য উজ্জল মুখ দেখে আমি কয়দিন আগের দেবদাস মামার মূচ্ছা যাওয়ার সেই দৃশ্য মিলাতে থাকলাম কিন্তু মিলাতে পারলাম না। জীবন যে এক অভিনয়ের মঞ্চ তখন আমার কচি মনে দাগ কাটলো।তিনি যেন দেবদাস নন রাজ্যজয়ী নবিন কুমার, পাশে তার প্রান প্রিয় নতুন রানী।

হায়রে ভালবাসা! হায়রে প্রেম!! চল্লিশ দিনও পার হতে পারে না দেবদাস থেকে নবিন কুমার হতে!!

আম্মাকে জিজ্ঞাস করলাম মামা এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করলো কেন আর কিছুদিন পরে করতে পারতো। আম্মা হেসে উত্তর দিল তার নাকি একা থাকতে ভয় লাগে।

বড় অদ্ভুত মানুষের সম্পর্ক যাকে ছাড়া দিন কাটে না সে মরে গেলে তার শূন্যতাও মানুষ বেশীদিন রাখতে চায় না।

তবে এর ব্যতিক্রম অনেক উদাহরণ আছে। যারা সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয় তার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের শূন্যতা অন্য কিছু দিয়ে পূরন না করে। অল্পদিনের কিছু সুখ স্মৃতি নিয়ে সারাটা জীবন পার করে দেয়। আমি জানিনা এ মানুষগুলো এতো শক্তি কোথা থেকে পায়।

স্যালুট সে সকল মানুষদের। যারা আমাদের শেখায় কি করে ত্যাগের মাধ্যমে শূন্যতাকে স্মৃতি দিয়ে ভরিয়ে রাখা যায়।

ভালবাসা বোধহয় তারে কয় যে হারিয়েও অন্তরে রয়।