ল্যারি জ্যাগান, জুন ১৩, ২০১৮ :
নতুন করে আন্তর্জাতিক চোরাবালিতে আটকা পড়েছে মিয়ানমার। রাখাইন রাজ্যে সমঝোতা কিভাবে করা যাবে, সেই উপায় খুঁজতে গিয়ে এ দশা হয়েছে তাদের। অতীতে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের যুদ্ধের মাঝখানে পড়েছিল মিয়ানমার। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন আর ইউরোপ সে সময় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল যাতে অং সান সু কিকে গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্তি দেয়া এবং দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। অন্যদিকে, এশিয়ার বিশ্বাস ছিল একাকিত্ব থেকে মিয়ানমারকে বের করে নিয়ে আসার জন্য আলোচনাই একমাত্র উপায়।

আবারও সেই প্রাচ্য পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছে মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে তারা। প্রায় এক মিলিয়ন মুসলিম শরণার্থী – যারা নিজেদেরকে রোহিঙ্গা বলে থাকে – তাদের সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে গণ-হিজরতের বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিরাট এক মানবিক বিপর্যয়। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা অভিযানের কারণ এই জনগোষ্ঠি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসী হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্য নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনী ওই অভিযানে নামে। যদিও সন্ত্রাসী, রাখাইন গ্রামবাসী এবং সেনাবাহিনীর হাতে যত বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার তুলনায় এ সংখ্যা কিছু নয়।

এখন বাংলাদেশে মানবিক সঙ্কট শুরু হচ্ছে। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার কারণে সেখানে জরুরি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার যে সঙ্কটের একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে এবং রাখাইন সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে, সে বিষয়টি নিয়ে পাশ্চাত্য যেন অজ্ঞই রয়ে গেছে। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অ্যাডভাইজরি কমিশন অব রাখাইন স্টেট গঠনের পর মিয়ানমারের প্রচেষ্টার ব্যাপারটি আবারও গোচরে আসলো।

রাখাইন রাজ্য নিয়ে মূল যে কোফি আনান অ্যাডভাইজরি কমিশন তৈরি করা হয়েছিল, সেখান থেকেই নতুন এই কমিশন গঠিত হলো। কোফি আনান কমিশন রাখাইনের সমস্যা নিয়ে এক বছর গবেষণা করেছিল এবং সমাধানের জন্য সুপারিশ করেছিল। ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বেসামরিক সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষেই ওই কমিশন গঠিত হয়েছিল এবং স্টেট কাউন্সিলরের এখানে শক্ত পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। কমিশনে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কোফি আনানসহ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রতিনিধিরা ছিলেন। রাখাইনে বহু দশকের গোষ্ঠিগত শত্রুতার পর কিভাবে সেখানে সহিংসতা এবং অবিশ্বাস কমিয়ে আনা যায়, সেটার নীল নকশা তৈরির জন্যেই ওই কমিশন গঠিত হয়েছিল। এটা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা হয়েছিল এবং যে পরামর্শগুলো দেয়া হয়েছিল, সেগুলো ছিল খুবই বিস্তারিত, সুচিন্তিত এবং বাস্তবসম্মত।

কিন্তু, যে দিন রিপোর্টের সুপারিশগুলো প্রকাশিত হয়, তার একদিন পরেই আরসার হামলা এবং পরবর্তিতে রাখাইনে সঙ্ঘটিত ঘটনাগুলো এই প্রতিবেদনকে ম্লান করে দেয়। কিন্তু সেখান থেকে সামনে না এগিয়ে কিভাবে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যায় সেগুলোর সুপারিশ না করে বিবেচনার জন্য নতুন ধারণার সুপারিশ করে এবং সেখানে কি ঘটেছে সেটা পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।

কোপেনহেগেনে ‘লেসন্স লার্নড’ রিপোর্ট প্রকাশিত হয় জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে। ড্যানিশ সরকারের খরচে প্রায় শ খানেক প্রতিনিধি এতে অংশ নেয়। এই রিপোর্টটি মূলত কমিশনের মূল কাজের একটি রিপোর্ট কার্ডের মতো। এটা ছিল মূলত হোয়াইট ওয়াশ রিপোর্ট। পশ্চিমা দাতারা যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দিয়েছে, সেগুলোকে হালাল করার জন্যই এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে এক কূটনীতিক বলেন, “অপারেশন ভালো হয়েছে যদিও রোগি মারা গেছে – আট ঘন্টারও কম সময় পরে”। এটাই ছিল মূল বিষয়। সন্ত্রাসী হামলা এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এগুলোকে অনেকটা অকার্যকর করে দিয়েছে। যে প্রশ্নটি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো এখন কি হবে: আর এ ব্যপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমাদের দিক থেকে খুব সামান্যই সমর্থন আসছে। সুপারিশগুলো আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হয়েছে। জাতিসংঘ সিকিউরিটি কাউন্সিলও স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা থেকে সেটা অনেক দূরে। এখানে দাবি করা হয়েছে যে, এটাই শহরের একমাত্র ঘটনা আর কিছু পশ্চিমা কূটনীতিক সেটা বিশ্বাসও করেন।

কমিশনের ৮৮টি সুপারিশের সবগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন কোন সমাধান হতে পারে না। অবশ্যই রিপোর্টে অগ্রাধিকারের কোন তালিকা দেয়া হয়নি বা সেগুলো বাস্তবায়নের কোন সময়সীমাও দেয়া হয়নি। সরকারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা সাউথ এশিয়ান মনিটরকে (এসএএম) বলেন, এগুলোর মধ্যে অন্তত আটটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা এখন সম্ভব নয়। সিনিয়র সরকারী কর্মকর্তারা খোলামেলা স্বীকারও করেছেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের বেশ কিছু নির্দেশনা রাখাইনের সরকার এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের লোকজন মানছে না। কিন্তু গত বছরের আগস্ট থেকে পরিস্থিতি বদলে গেছে।

শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা, তাদেরকে নিরাপদ পরিবেশে আবাসনের ব্যবস্থা করা এবং রাখাইনে বোঝাপড়া এবং উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নতুন কৌশল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। তাদের এই প্রচেষ্টাগুলোর অধিকাংশই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখছে না বা এড়িয়ে যাচ্ছে।

অবশ্যই দেশের বেসামরিক সরকারের দিক থেকে পরিবর্তন এসেছে। আরসার হামলা এবং দেশের নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক কথিত বর্বরতার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশের পর, অং সান সু কি এবং তার মন্ত্রীরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিলেন। তারা সামরিক বাহিনীর আচরণের নিন্দা করতে এবং এমনকি এ ধরনের কিছু ঘটার কথা স্বীকার করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কি ঘটেছে, সেটা তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব ধরনের চেষ্টাকে প্রতিহত করেছিলেন তারা। জাতিসংঘের সাথে সহযোগিতার প্রস্তাব এবং তাদেরকে প্রবেশাধিকার দিতেও অস্বীকার করেছিলেন তারা। উল্টো এশিয়ার বন্ধুদের দিকে মুখ ফিরিয়েছিলেন তারা – বিশেষ করে চীনের দিকে। বহু পশ্চিমা দেশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল এবং সে সব আন্তর্জাতিক চাপ থেকে বাঁচতেই চীনের দিকে মুখ ফিরিয়েছিল সরকার।

মিয়ানমারের একজন কূটনীতিক বলেছেন, “আমাদের সরকারের জন্য এটা নতুন যুগ। একটা কৌশল তৈরি হয়েছে। যেহেতু রাখাইন ট্রাজেডিটা আমাদের সবার উপর চেপে বসেছে, তাই আরও প্রতিক্রিয়ামূলক কৌশল নেয়া হয়েছে”। সরকার, আমলা এবং এমনকি দেশের শীর্ষ নেতারাও রাখাইনের ঘটনাপ্রবাহ এবং এগুলোর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। কিন্তু এখন একটা বোধোদয় এসেছে যে, নাটকীয় একটা কিছু করতে হবে আর সেজন্য সরকারের আন্তর্জাতিক সহায়তাটা খুবই প্রয়োজন।

কিন্তু নীতির পরিবর্তনের প্রথম লক্ষণ দেখা গেলো যখন সরকার অপ্রত্যাশিতভাবে জাতিসংঘ সিকিউরিটি কাউন্সিলের সফরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। মে মাসের শুরুর দিকে ওই সফর হয়। সরকারকে যে জাতিসংঘের সাথে কাজ করতে হবে, এটা ছিল তার একটা স্বীকৃতি। বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের (আইসিসি) সম্ভাব্য তদন্তের ক্ষেত্রে এই সহযোগিতা করতে হবে। আইসিসি শিগগিরই তাদের আইনি বাধ্যবধকতার বিষয়টি স্পষ্ট করবে।

জাতিংঘের বিশেষ দূত হিসেবে ক্রিস্টিন শ্রানার বার্জেনারের নিয়োগকেও তাৎক্ষণিক মেনে নিয়েছে সরকার। সুইস এই কূটনীতিক আগে থাইল্যান্ডে রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মঙ্গলবার দূত হিসেবে তার প্রথম সফরের অংশ হিসেবে ইয়াঙ্গুন পৌঁছেছেন। তার সামনে কঠিন কাজ। জাতিসংঘ মুখপাত্রের মতে, রাখাইন রাজ্য, শান্তি প্রক্রিয়া, গণতান্ত্রিকীকরণ এবং মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে কাজ করবেন তিনি। জাতিসংঘের তথ্য মতে, তিনি বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও সফর করবেন।

এর পর রয়েছে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সাথে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর। কূটনৈতিক ও জাতিসংঘ সূত্রে জানা গেছে, সরকারের অনুরোধে চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাতিসংঘের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, সম্মানের সাথে এবং স্থায়ীভাবে তাদের মাতৃভূমি বা পছন্দের জায়গায় প্রত্যাবাসনের জন্য দরকারী পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই সমঝোতা স্মারক একটা সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করবে”।

এবং চূড়ান্ত বিষয় হলো, রাখাইনের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই তদন্ত কমিটিতে একজন বিদেশী বিশেষজ্ঞ এবং দুজন মিয়ানমারের প্রতিনিধি থাকবেন। সরকারের ভেতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চলছে এবং শিগগিরই তাদের নাম ঘোষিত হবে। এখন পর্যন্ত এটা পরিস্কার নয় বিদেশী প্রতিনিধি কমিটির প্রধান হবেন না কি মিয়ানমারের দুজন প্রতিনিধির একজন এর প্রধান হবেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বাগত জানিয়েছে। একই সাথে তারা এটাও বলেছে যে তদন্তকে স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। এই জায়গাতে কোন ঘাটতি থেকে গেলে মিয়ানমার সরকারকে আবারও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি হতে হবে।

অং সান সু কির আরেকটি পদক্ষেপ হলো আনান কমিশনের বাইরে একটা অ্যাডভাইজরি বোর্ড গঠন করা। যেটার প্রধান হলেন সাবেক থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ড. সুরাকিয়ার্ত সাথিরাতি। গত ডিসেম্বরে গঠিত এই বোর্ডেও আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এই বোর্ড দৃশ্যপটের আড়ালে কাজ করে এবং সরকারকে বিভিন্ন সৃজনশীল ধারণার প্রচার এবং রাখাইনে সমঝোতা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করে। সরকারের ভেতরের একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

তাদের উপদেশ থেকে এরইমধ্যে ফল আসতে শুরু করেছে। তারা স্বাধীন তদন্ত টিম গঠনের পরামর্শ দিয়েছে এবং জাতিসংঘ সিকিউরিটি কাউন্সিলকে সফরের অনুমতি দেয়ার জন্য অং সান সু কিকে বুঝিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের মধ্যে যে সেতুবন্ধনের দরকার ছিল, সেই সেতুবন্ধনের কাজ করছে এই উপদেষ্টা বোর্ড। এটাই সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতি এবং আনান কমিশনের ফলো-আপ রিপোর্ট এ ব্যাপারে ক্রেডিট নিতে পারে। এর শেষে বলা হয়েছে: “মিয়ানমার এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে সম্পর্কের যখন মারাত্মক অবনতি হচ্ছে, তখন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে”।

মিয়ানমার সরকারের হয়তো নতুন কৌশল রয়েছে যেটা শুধু কথার কথা নয়, কিন্তু নাগরিকত্বের প্রশ্নটির মীমাংসা না হলে রাখাইন রাজ্যের সমস্যার কোনদিনই সমাধান হবে না। এটা এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে কাজ করতে সরকারের খুব একটা আগ্রহ নেই।