শিক্ষার অভাব

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল, ২০১৮ ০৬:০৩

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন

মানুষ সহজাত অনুসন্ধিৎসা মন নিয়ে জন্ম গ্রহন করে। এর সুষ্ঠু বিকাশ সাধন করাই হলো শিক্ষা লাভ। সমাজে আন্ডার মেট্রিক, আই, এ, বি, এ এম , এ ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তার প্রভৃতি পাশ লোকের অভাব নেই। এই সব লোককে শিক্ষিত বলে ধরে নেওয়া হয়। আমি শিক্ষিত লোকের যে মাপকাটি উলেলখ করেছি, সেই মাপকাটি মোতাবেক তাঁদের মুল্যায়ন করা হোক। সহজাত অনুসন্ধিৎসা,অর্থাৎ প্রকৃতি প্রদত্ত প্রবৃত্ত্বিরও বিকাশ না ঘটিয়ে একে ভোঁতা ও অকেজো করে ফেলা হয়।যেমনটি কেমেস্ট্রিতে পড়াশুনা করার পর ব্যাংকের ম্যানেজার হওয়া, মেরিন বায়লজিতে পড়াশুনা করার পর ওকালতির ব্যাবসা করা ইত্যাদী শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতি বিরোদ্ধ কাজ নয় কি?

এ প্রসঙ্গে উলেলখ করা দরকার শিক্ষিত বলতে কি বুঝায়, সে বিষয়ে এই উপমহাদেশে ভুল ধারণা রয়েছে। বহুক্ষেত্রে সাক্ষরকে শিক্ষিত হিসেবে ধরা হয়। সরকারও অনেক সময় তা করে থাকে। কিন্তু সাক্ষর ও শিক্ষিত সমার্থক হতে পারে না। শিক্ষিত কথাটা অনেক ব্যাপক, এর সাথে সাক্ষর শব্দটি সমার্থক হতে পারেনা। যথার্থ শিক্ষিত হতে হলে বহু সাধনার প্রয়োজন। সেই হিসেবে তুলনা করতে গেলে এদেশে সাক্ষরের হার যদি শতকারা বিশ হয় শিক্ষিতের হার বোধকরি দুই ও হবেনা।

এও সত্যি কোন শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের সব কিছু শিখিয়ে দিতে পারেননা। Student is not a vessel that to be filled. জ্ঞানের কোন বেড় নেই। শিক্ষকের কাজ হলো ছাত্রদের মধ্যে বোধশক্তি, তার জ্ঞানের আগ্রহকে সমৃদ্ধ করে তোলা উচ্চায়ত পৃথিবীর চিত্র তার সামনে তোলে ধরে তাকে সেদিকে আহবান করতে হয়। বলতে হয় এদিকে এস, এখানে তোমার সম্ভাবনা। এখানে তোমার বিকাশ। এখানে তোমার আলাকোজ্জল মুক্তি। এই পুরু কাজটাই তাঁকে করতে হয় কথার মাধ্যমে। তাই শিক্ষকের জীবনে কথার গুরুত্ব এতই গুরুত্বপুর্ণ। ছাত্রের জীবনকে চারিদিক থেকেই তাঁকে জাগিয়ে তোলতে হয়। এই জন্য তাঁর কথার ভেতর কথা বলার উচু মাপের ক্ষমতা থাকতে হয়। তা না হলে এই অসাধ্য সাধন করা, উচু মাপের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না।

কিন্তু এদেশে শিক্ষার নামে তার বিপরিত কাজটিই করা হয়।তাকে পরীক্ষা পাশের জন্য কিছু বুঝে, বেশীর ভাগ না বুঝে প্রশ্নোত্তর মুখস্ত করান হয়।অনেকে না বুঝে বাংলাথেকে ইংরেজি অনুবাদ ব্যাখ্যাও মুখস্ত করে। এভাবে মানব সন্তানকে তোতা বানানো হয়। না বুঝে উত্তর মুখস্ত করে যারা পরীক্ষা পাশ করে সেই তোতা পাখীদের কি শিক্ষিত বলা চলে? টিউটররা যেন তেন প্রকারেন কতগুলো সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর শিখিয়ে ঐ সব তোতা পাখীদের গোল্ডেন + পাইয়ে দেন।পরবর্তীতে কোন উচ্চতর পড়াশুনার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। এদের কি শিক্ষিত বলা যায়? কাজেই তার সর্বশেষ নির্ভরযোগ্য আশ্রয় হয়ে দাড়ায় হয় প্রশ্ন পত্র ফাঁস কিংবা নকল। বেশ কিছুদিন আগে কোন একটা টিভি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছিল দুস্টচক্র টাকার বিনিময়ে কিভাবে ূএস আই এফ ফরম জালিয়াতি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রংহোল্ডরুম থেকে উত্তর পত্র পাল্টানোর বিষয় নিয়ে। এভাবে অনেক মেধাবীছেলেকে পদানত করে গাঁধাছেলেদের “গোল্ডেন এ+ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপার সত্যি আমাদের ভাবিয়ে তোলে।

আজ আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা নানা দিক থেকে দু:খজনক অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। শিক্ষাগৃহ আজ স্কুলগৃহ থেকে শিক্ষকের বাড়ীতে বাড়ীতে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিটি শিক্ষকের বাসাই আজ এক একটি দোকান। কারণ যেনতেন প্রকারে স্কুলের ক্লাস সেরে বাড়ী কিংবা নিজের কোচিংসেন্টারে এক দল ছাত্রকে পড়াতে পারলে অনেক টাকা। মুক্তবাজার অর্থনীতির আদর্শে সেখানে বিদ্যার অবাধ বেচাকেনা চলছে। কোন কোন শিক্ষকের বাড়ী যে এক একটি সুপার মার্কেট।

এতে করে অভিবাবকরা একজন আদর্শ শিক্ষক এবং কোচিং সেন্টারের শিক্ষকে এক করে ফেলেছেন। আজ অভিবাবকরা কি চাচ্ছেন? তাঁরা চাচ্ছেন শিক্ষকেরা তাঁদের সন্তানদের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার সব রকম চেস্টা করুন। ঐ চেস্টাতেই তাঁদের সব রকম সাফল্য,তাঁদের যে সার্থকতা। ছাত্রদের আজ আর কেউ শিক্ষার্থী হিসেবে দেখতে চাননা। চাচ্ছেন পরীক্ষার্থী হিসেবে। আমি কিন্তু এটা মনে করিনা । আমি মনে করিনা যে একজন শিক্ষকের কাজ বা দায়িত্ব ছাত্রকে কেবল মাত্র ভালো নম্বর পাওয়ার উপযুক্ত করে তোলা। এটা যিনি করেন তাঁকে কিন্তু শিক্ষক বলা যাবেনা। তাঁর আর একটি নাম আছে । ইংরেজী ভাষায় তার নাম হচ্ছে Tutor.তিনি টিউটর কোচিং সেন্টারের ইনস্ট্রাকটার। শিক্ষক নন। শিক্ষক টিউটরের চাইতে অনেক বড়। শিক্ষক ছাত্রের কাছে পড়ানোর বিষয়টি তোলে ধরার পাশাপাশি ছাত্রের হৃদয়ে ঐ বিষটির প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলতে চেস্টা করেন। যে বিষয়ে শিক্ষক পড়ান সে বিষয়টি ঘিরে শিক্ষকের মধ্যে যে আনন্দ আর ভালোবাসার উতাল পাতাল হয়েছে সেটা তাঁকে উচ্ছল শব্দে প্রতিভাবান ছাত্রের হৃদয়ে সঞ্চার করতে হবে। এটা যদি তিনি না পারেন তবে তিনি কখনই সফল হবেন না। যত বড় মাপের শিক্ষকই হোকনা হোক আর ছোট মাপে শিক্ষকই হোক, তাঁকে সুন্দর অনবদ্যভাবে কথা বলার ক্ষমতা তার মধ্যে থাকতে হবে। না হলে শিক্ষক হিসেবে তিনি ব্যর্থ হয়ে যাবেন। যদি শিক্ষকের কথার মধ্যে লালিত্য ও প্রসাদগুন না থাকে তাহলে সে কি হতে পারে শিক্ষক?

এখন তাদের কথায় আসি , যারা নিয়মিত পড়াশোনা শেষ করে পরীক্ষা পাশ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরী কিংবা অন্য পেশা অবলম্বন করেছেন।শিক্ষা জীবন শেষ হওয়ার পর তারা অনেকে মনে করেন যে, এখন তো ছাত্র নই, সংসারী মানুষ, বই পত্র পড়ার কি দরকার কি। এরকম চিন্তাধারা ব্যক্তির জীবনে এবং জাতীর জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছে।শিক্ষা জীবন শেষ করে বই পত্র না পড়ার অর্থ দাড়ায় আপনি শিক্ষার পথ ছেড়ে অশিক্ষার পথ অবলম্বন করেছেন।আর কিছু না শেখার পশ্চাদযাত্রা শুরু করেছেন।কাজেই আপনাকে শিক্ষিত লোকের তালিকায় রাখা যায়না। অন্যান্য প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে পার্থক্য হলো। মানুষের মন বলে একটা জিনিষ আছে।তার মনন শক্তি আছে।এই মনের নিরন্তর উৎকর্ষ সাধনের জন্য সংগ্রাম করলেই মানব জীবনের সফলতা আসবে।মানুষ পেট পুরে খেতে পায়না এ জন্য সমাজ ব্যাবস্থাই দায়ী , কিন্তু আপনি যে শিক্ষিত লোক বই পত্র না পড়াতে আপনার ক্ষতি হচ্ছেনা বলে মনে করে থাকেন। এতে আপনি আপনার মনকে উপবাসী রাখেন। মনের খোরাক সরবরাহ করেন না।এজন্য সমাজ ব্যবস্থা দায়ী নয় আপনি দায়ী। “দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন কর”। এই হাদিসের উক্তি শিক্ষিত লোকেরা উপলব্দি করেন না। যে সব শিক্ষিত লোক বই পত্র পড়েন না তাদের কি শিক্ষিত বলা যায়?

শিক্ষা ব্যবস্থায় বিকৃতির কারনে চাকরি প্রার্থিদের প্রশ্ন করে যে উত্তর পাওয়া যায় তা শুনলে কাঁদবেন না হাসবেন তা ঠিক বলা যায় না।এক আই এ পাশ ছাত্র লিখেছে প্যারিস হল হিমালয়ের রাজধানী। শ্রীমঙ্গল ভারতে অবস্থিত।শ্রীমঙ্গল শ্রীলংকার রাজধানী।চন্দ্রঘোনা খোলনায় অবস্থিত। এদের জ্ঞানের পরিধি দেখুন।

প্রমথ চৌধুরী বলেছেন,সুশিক্ষিত মানুষ মাত্রই স্বশিক্ষিত। দু:খ লাগে যখন যখন কোন কোন চাকরীজীবি বা ব্যাবসায়ী বন্ধু বলেন,“ স্কুল কলেজে বই পত্র পড়তাম , এখন আর পড়িনা।”

নিজের কথায় আসি, নার্সারী থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত প্রায় জীবনের প্রায় ৩০ টি বছর শিক্ষকতা করেছি।এর সাথে সকল বিদ্যার শ্রেষ্ট বিদ্যা সঙ্গীতের উপর শিক্ষকতা আজও করে চলেছি। জীবনের মাগরিব ওয়াক্তে, জীবন নাটকের পঞ্চম অংকে পৌছে নানা হৈ চৈ এর মধ্যে দিনগুলি কেটে গেছে। দেশ বিদেশের যত বিখ্যাত পুস্তক পড়া উচিত ছিল তা যথাযথ পড়া হয়নি। তাই গুনি জ্ঞানীদের সমাবেশে নিজেকে খুবই সংকোচ বোধ করি।নিজের এই ব্যর্থতা মনকে খুব নাড়া দেয়। তাই আমার চেয়ে যারা কম বয়েসি তাদের বলি “সময় থাকতে জ্ঞানার্জন কর। সময় হলো শ্রেষ্ট সম্পদ। এর যথাযথ ব্যাবহারে জাতীর উন্নতি,জাতির অগ্রগতি নিহিত রয়েছে।আজ জাতির জীবনে মুল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। গ্রন্থ কেন্দ্রে মুল্যবান বই গুলো বুড়ো প্রজাপতির মতো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।এটা জাতির জন্য চরম বিপদ সংকেত।আমি একজন নেহাতই নগন্য মানুষ। বিভিন্ন সভা সমিতিতে আমি আমার প্রিয় ছাত্রদের বলি “বই হলো মনের খোরাক,যে সব শিক্ষিত লোক বই পত্র পড়েননা,তারা তাদের মনকে উপবাসী রাখার অপরাধে অপরাধী। তারা সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত লোক নন।”