সিবিএন ডেস্ক:
বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার লৌকিক খেলাধুলা। গ্রামের মাঠেঘাটে, পথেপ্রান্তরে এসব খেলার ধুম এখন আর চোখে পড়ে না। আধুনিকতার স্রোত, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ভিডিও গেম, যান্ত্রিক সভ্যতা, স্যাটেলাইট কালচারের বিকাশ, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রামসহ নানা কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে গ্রামীণ খেলাধুলার গণ্ডি। তবে শৈশব ও কৈশোরের সেসব খেলাধুলার স্মৃতি অনেককে আজও নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে।

গ্রামীণ খেলাধুলার মধ্যে নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে বাঙালির জাতীয় চরিত্র, জীবনধারা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। অজপাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষ নিজেদের শরীরচর্চা ও চিত্তবিনোদনের জন্য অসংখ্য খেলার জন্ম দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে পল্লিজীবনের সৃজনশীল মনের ছাপ পাওয়া যায়।

আবহমানকাল থেকে বাংলার গ্রামগঞ্জ ছিল বিচিত্র খেলায় ভরপুর। অধিকাংশ খেলার সঙ্গে রয়েছে ছড়ার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র। অনেক খেলার মূল আকর্ষণই হচ্ছে আঞ্চলিক ছড়া। এসব ছড়া খেলোয়াড়দের দেহ ও মন চাঙা করে। যেমন ‘ব্যাঙ মারবি যে, ব্যাঙের ভাতার সে’, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ’, ‘ঢেং ঢেং সোয়ারি বউয়ের মাথাত তাগারি/ বউ বড় ভারী, তালগাছের গুঁড়ি’, ‘পাকিরে পাকি/ আম ফেল্যা দে পাকা আমোত ক্যানে পোকা/ ধর শালীর খোঁপা’ প্রভৃতি।

ছড়া ছাড়াও গ্রামীণ খেলাধুলায় ধর্ম, লোকবিশ্বাস ও মন্ত্রশক্তির প্রভাব আছে। পুরোনো গল্প, প্রাচীন মন্দিরের ভাস্কর্য, বীরত্বগাথা, গান, টেরাকোটা ফলক প্রভৃতি আদিম খেলাধুলার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। প্রাচীন যুগে পালাপার্বণ, বিয়ে ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করা হতো। সেসব খেলাধুলার কিছু কিছু এখনো টিকে আছে অনাদরে-অবহেলায়।

শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সী নারী ও পুরুষের জন্য প্রচলন রয়েছে পৃথক খেলার। কোনো কোনো খেলা শুধুই মেয়েদের জন্য। আবার কোনো খেলা কেবল ছেলেদের জন্য। কিছু খেলায় ছেলে ও মেয়ে উভয়েই অংশ নিতে পারে। ঘরের খেলার যেমন কদর রয়েছে, তেমনি বাইরের খেলার কদর আরও বেশি। ডাঙার খেলা ছাড়াও পানির খেলা কম আনন্দদায়ক নয়। কোনো কোনো খেলায় দেহ ঘর্মাক্ত ও ক্লান্ত হয়, আবার কিছু খেলায় খাটাতে হয় মেধা ও বুদ্ধি।

ডাংগুলি বা ডান্ডাগুলি গ্রামের ডানপিটে স্বভাবের চঞ্চল কিশোরদের প্রিয় খেলা। বাংলাদেশে প্রথম ক্রিকেট খেলার প্রচলন যখন ঘটে, তখন ক্রিকেটকে ডাংগুলি খেলার আধুনিক রূপ বলে মনে করা হতো। গ্রামবাংলায় মার্বেল ও গুলি খেলা, লাটিম ঘোরানো, হাডুডু, গুলতি মারা ছিল কিশোরদের অতি প্রিয় খেলা।

মেয়েদের খেলার মধ্যে চারকড়ি, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, কিতকিত, বুড়ির চি বা ছি ধরা, আঁচাবাটি বা টোপাভাতি, ঝুমুর ঝুমুর, গোল্লাছুট উল্লেখযোগ্য।

ঘরের খেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পুতুল খেলা, জোড়–বেজোড়, বিশ কাঠি, ষোলো ঘুঁটি, এলাডিং বেলাডিং, উবু দুবু, চুড়ি ভাঙ্গা, লুডু খেলা ও বাঘবন্দী।

বাইরের খেলার মধ্যে আছে কানামাছি ভোঁ ভোঁ, কাঁঠাল চুরি, টিলো এক্সপ্রেস, শাক ভাত, ঘুড়ি ওড়ানো, ইচিং বিচিং। পানির ভেতরও অনেক খেলার ধুম পড়ে যেত, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডুবসাঁতার, ডুবাডুবি, ব্যাঙ লাফানো, চিলি ও হাঁস হাঁস খেলা, আবুর মার টাপুরটুপুর।

প্রাতিষ্ঠানিক অনেক খেলা আছে যেগুলো এখনো মাঝেমধ্যে দেখা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণত এসব খেলা হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে ককফাইট বা মোরগ যুদ্ধ, বালিশ বদল, রুমাল চুরি, হাঁড়ি ভাঙা, সুচে সুতা, চামচে মার্বেল নিয়ে দৌড় প্রভৃতি।

এত সব খেলার ভিড়ে বয়স্কদের জন্য খেলা থাকবে না, তা কি হয়? বলীখেলা, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, কুস্তি, পাশা খেলা একসময় প্রিয় ছিল।

লোকায়ত খেলাধুলার উদ্ভব কোন সময়, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে অনুমান করা হয়, অনার্য বা দ্রাবিড় যুগ থেকে এ ধরনের খেলার উদ্ভব। প্রাচীন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস, রীতিনীতি ও বিশ্বাস জড়িয়ে আছে অনেক খেলায়। নরসিংদীর গ্রামে প্রাপ্ত এই অঞ্চলের প্রাচীন রৌপ্যমুদ্রায় ষোলো ঘুঁটি ও বাঘবন্দী খেলার খোদাই করা ছক দেখা যায়। এটা দেখে ধারণা করা হয় যে এ ধরনের খেলার উৎপত্তি মৌর্য বা মৌর্য–পূর্ব যুগে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আত্মরক্ষার্থে দৌড়, লাফ, কুস্তি ও লাঠিখেলার প্রচলন ঘটে। কৃত্রিম যুদ্ধের খেলা দাবা। ব্রিটিশ জাতিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করার জন্য গুড্ডি বা ঘুড়ি খেলার প্রচলন ঘটে। তখন ইংরেজ জাতির প্রতিমূর্তি ঘুড়ি আকারে তৈরি করে নাক, কান ও কোমরে সুতা লাগিয়ে আকাশে ওড়ানো হতো। এতে ব্রিটিশ সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে এক আদেশ জারি করে। ঘুড়ি তৈরির কারিগর ও খেলোয়াড়দের কঠোর শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় ঘুড়ি খেলা।

দেশে লৌকিক খেলাধুলার উপকরণ খুবই সহজলভ্য। কাদা, মাটি, লাঠি, বাঁশ, ইটের টুকরো, কড়ি, লতা-পাতা, ফল-ফুল, কাঠের টুকরো, পাথর প্রভৃতি খেলাধুলার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব উপকরণ সংগ্রহে খরচ নেই বললেই চলে।

গ্রামীণ খেলাধুলার মাধ্যমে নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা, ধৈর্য, একতা, নৈতিকতা, বন্ধুত্ব প্রভৃতি গুণের বিকাশ হয়। প্রায় সব খেলাতেই রয়েছে নেতৃত্বের প্রশ্ন। দলপতি, রাজা, বউ, বর, বুড়ি প্রভৃতি নামে খেলোয়াড়দের মধ্য থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। কোনো কোনো খেলায় রেফারি বা মধ্যস্থতাকারী অত্যাবশ্যক।

লৌকিক খেলায় খেলোয়াড় বণ্টনের পদ্ধতিগুলোও বেশ চমৎকার ও ভারসাম্যপূর্ণ। যেমন বুড়ির চি (বা চি বুড়ি) খেলায় দুজন দলপতি নিরপেক্ষভাবে খেলোয়াড় বাছাই করে। দুজন খেলোয়াড় গোপনে ছদ্মনাম পাতিয়ে দলপতিদের সামনে আসে এবং বলে, ‘ডাক ডাক ডাক কিসকো’। দলপতিদ্বয় তখন বলে, ‘আম মারি মিসকো’। তখন খেলোয়াড়েরা বলে, ‘কে নেবে আকাশ, কে নেবে বাতাস’। দলপতিরা কারও নাম জানে না। অনুমানের ওপর তারা যেকোনো একজনকে বেছে নেয়। এভাবে অধিকাংশ গ্রাম্য খেলায় নিরপেক্ষভাবে খেলোয়াড় বাছাই করা হয়।

নগরবৃত্তের বাইরে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খেলা। এগুলো নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের একেক অঞ্চলে শিশু-কিশোরেরা একেক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা চিংড়ি পোনা ধরতে ব্যস্ত থাকে। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, পতেঙ্গাসহ সমুদ্রসৈকতে শিশু-কিশোরেরা শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। জেলেরা তাদের আট-দশ বছর বয়সী সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে।

গ্রাম থেকে শহরমুখী জনস্রোতে কাজের সন্ধানে ছুটে আসছে অসংখ্য শিশু-কিশোর। তাদের ঠাঁই মিলছে পোশাক কারখানায়, বাসাবাড়িতে। জীবন-জীবিকার সঙ্গে তাদের এত ঘনিষ্ঠতা অতীতে ছিল না।

গ্রামের সুখ-সমৃদ্ধি, বিত্তবৈভব, অখণ্ড অবসর, আনন্দ-ফুর্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে। শহরের যান্ত্রিক জীবন গ্রামকেও স্পর্শ করেছে। গ্রামের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে টেলিভিশন, ভিসিডি, ভিসিআরসহ নানা বিনোদন সামগ্রী। মোবাইল, ইন্টারনেট, ভিডিও গেম তাদের অবসরকাল দখল করে রাখছে। এসবে চাপা পড়ে যাচ্ছে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা। আমরা আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতিবিমুখ নই। পুরোনোকে পুরোপুরি আঁকড়ে থাকতে চাই না। তাই বলে লৌকিক খেলাধুলা এভাবে হারিয়ে যাবে, এটাও কাম্য নয়।