রহিম আব্দুর রহিম :

বাঙালির চিরচেনা বৈশাখ মাসেই পালন করা হয় নববর্ষ। নববর্ষ শুধু বাঙালিরাই পালন করে না , পৃথিবীর বহু দেশই তাদের নিজ নিজ চেতনায় নববর্ষ পালন করে থাকে। গবেষকদের মতে, প্রায় ৪ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনে নববর্ষ তথা বর্ষবরণ উৎসবের সূচনা ঘটে। ইতিহাস স্বাক্ষ দেয় ভারত, কোরিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মায়ানমার, সুইজারল্যান্ড, ইরান, ভিয়েতনাম, রাশিয়া, চীন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো ও জাপানের মানুষরা বর্ষবরণ করে ধর্মীয় আচার-আচরণে, দেশীয় সংস্কৃতির আবরণে; আবার কোন কোন দেশে ব্যাপক কুসংস্কারাচ্ছন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালিত হয়। বাঙালির নববর্ষের ইতিহাস প্রমাণ করে, বাঙালির চিরচেনা বৈশাখের নববর্ষের সূচনা করেন সম্রাট আকবর, সেই ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে, হিজরী ৯৬৩ সনে। অনেকেই মনে করেন বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ আগেও চালু ছিল। সম্রাট আকবর শুধু খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বৈশাখকে প্রথম মাস হিসাবে গণনায় আনেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ মতামত দেন, গৌড়রাজ শশাঙ্কের সিংহাসনে আরোহনের সময় ৫৯৩ বা ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাব্দ চালু হয়। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও রাধারমন এই মতকে সমর্থন করেছেন। প্রখ্যাত কবি, কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক সুশীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে বাংলা সন চালু হয়েছে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল সোমবার থেকে।

বাংলা সনের শুরুটা যখনই হোক না কেন, বাংলার ইতি-ঐতিহ্য, জীবনযাত্রা, সুর-সঙ্গীত, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচারে আদিকাল থেকেই ছাঁপিয়ে আছে বাংলা সনের প্রভাব। জাতীয় স্বাধীনতা দিবস, মহান একুশ, বিজয় দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবেই যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলাদেশে পালিত হয়। এর আবেদন-নিবেদন জাতির বিবেকে প্রচন্ডভাবে প্রজ্জ্বলিত হলেও যা তৃণমূলে খুব একটা পৌঁছায় না। অথচ বৈশাখের নববর্ষ তৃণমূলের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় চেতনার শিখরে পৌঁছেছে। যে বিষয়টি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার খুব দ্রুত বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন; ফলে অন্য কোন জাতীয় চেতনা সমৃদ্ধ উৎসবের জন্য ভাতা চালু করেন নি, চালু করেছেন বৈশাখী ভাতা। এক্ষেত্রে সরকারি, বে-সরকারি বৈষম্যের কারণে বাঙালির সমষ্টিগত বৈশাখ উৎসবে কিছুটা ছেদ পড়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। যা কিছুই হোক না কেন, বৈশাখ মাস যেমন বাঙালির প্রিয় মাস, তেমনি নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব, যে উৎসব কোন ঘোষণা ছাড়াই বাংলার আনাচে-কানাচে উদযাপিত হয়ে আসছে।

নববর্ষের উদ্বেলিত রক্ত ধমনীই পারবে বাংলাদেশকে সন্ত্রাস এবং মাদকমুক্ত করতে। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে বৈশাখ ঘিরে বাংলার ঘরে-ঘরে পুরাতনের বিদায় এবং নতুনকে বরণের যে আনুষ্ঠানিকতা চলেছে, তা কারো কাছ থেকে ধার-দেনা করা বা পাশ্চাত্য কোন সংস্কৃতি নয়। একেবারেই বাঙালির প্রাণের নিগুঢ় থেকে উঠে আসা। বছরের শুরুতেই ব্যবসায়ীদের হালখাতা, ঘরে ঘরে ধোয়া-মোছা। সারাদেশের ্১৯ টি জেলায় একসময় প্রতিবছর ১৬২ টি বৈশাখী মেলা বসতো, এর মধ্যে ঢাকা জেলায় ১৯টি, নোয়াখালী জেলায় ৮টি, মুন্সিগঞ্জ জেলায় ৫টি, গোপালগঞ্জ জেলায় ১১টি, বরিশালে ১০টি, পটুয়াখালীতে ৭টি, ফরিদপুরে ৯টি, কুষ্টিয়ায় ২টি, যশোরে ২টি, খুলনায় ৫টি, ময়মনসিংহে ১২টি, টাঙ্গাইলে ৪টি, জামালপুরে ৪টি, রংপুর জেলায় ৯টি, দিনাজপুরে ১৩টি, কুমিল্লায় ১৮টি, চাঁদপুরে ৯টি, ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় ৮টি এবং চট্টগ্রাম জেলায় ৭টি। এ সমস্ত বৈশাখী মেলায় নাগরদোলা, চরকি, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা, ঘোড়দৌঁড়, ষাঁড়ের লড়াই, পালাগান, সার্কাস, জারি-সারি, কবিগানের আসর, মোরগ লড়াই, লাঠি খেলায় মত্ত থাকত ্ওই সময়ের শৈশব-কৈশোর। মেলায় বেচাকেনা হতো কৃষি যন্ত্রপাতি লাঙল,জোয়াল, মই, বিন্দা, শিশুদের খেলনা পুতুল, বাঁশি, খাওয়ার জন্য লাড়–, মুড়ি-মুড়কি, খৈয়ের মোয়া, শিরার গুড়, বাতাসা। গ্রীষ্মকালীন ফল ডাব, তরমুজ, খিরার পসরাও কম ছিলনা। শহরে বেঁচা-কেনা হতো মাটি ও কাঠের তৈরি বাঘ, হরিণ, হুতুমপেঁচা, নৌকা, চিল, ঘুড়ি। বেঁচাকেনা হয়েছে সূচীশিল্প, প্রসাধনী, গামছা, লুঙ্গি, আটপৌরে ডুরে শাড়ি, নীলাম্বরী, আচলচোড়া শাড়ি। এখন যা বিলুপ্ত; এতে যা হবার তাই, যান্ত্রিক যুগে যাঁতাকলে পিষ্ট যুবসমাজ এখন নেশার রাজ্যে অন্ধ অধিপতি। বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখের নববর্ষ দেশপ্রেম, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ জাতি গঠন করতে সক্ষম। শুধু তাই নয় অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম উৎস হতে পারে বৈশাখের নববর্ষ। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দায়িত্বশীলদের ভাবতে হবে। গ্রামের মেলায় সেই তালপাতার বাঁশি থেকে শুরু করে নকশী কাঁথার মাঠ পেরিয়ে আমরা বাংলার ঐতিহ্য বাঙালির হাতের তৈরি কৃষিজ তৈজস পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হচ্ছে। অবুঝ শিশু থেকে শুরু করে বয়:বৃদ্ধদের মাঝেও হাতবদল ঘটে পণ্যের, লেনদেন হয় অর্থের। জাতির খেঁটে খাওয়া মানব সম্পদ বৈশাখের নববর্ষের মেলা ঘিরে বছরের প্রারম্ভে নিজের চিন্তা-চেতনা ধ্যান ধারণা আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেন মনের অজান্তে। বাঙালির প্রিয় বৈশাখ এবং প্রাণের নববর্ষের উৎসবের সৌন্দর্য রুপ-রসের অন্তরালে প্রায় ৮০ হাজার গ্রামের ১৬ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম ক্ষেত্রটি যে চাপা পড়ে আছে, তাতে কোন সন্দেহ নাই । আমরা কি পারি না মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে বাঙালির প্রিয় বৈশাখের নববর্ষকে যুব সমাজকে উপহার দিতে ?

বাঙালির আদি সংস্কৃতির চিরচেনা মুখ প্রজ্জ্বলিত করতেই বাঙালির বৈশাখের নববর্ষ নিয়ে নতুন ভাবনা এখন সময়ের দাবী।

রহিম আব্দুর রহিম

লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিক্ষক

মোবাইল: ০১৭১৪-২৫৪০৬৬

ই-মেইল: rahimabdurrahim@hotmail.com