রহিম আব্দুর রহিম :

১৯৭১। স্কুল-কলেজ বন্ধ। সবার মুখে শ্লোগান ‘জয় বাংলা, জয়হিন্দ, লুঙ্গী থুইয়্যা ধুতি পিন।’ আমি তখন ছোট। বাবা, গ্রামের আর দশজনের মত কাঠের ব্যবসা করেন। ব্যবসাস্থল মধুপুর গজারিবন থেকে সরিষাবাড়ি বাজারে। সরিষাবাড়ি যেতে হলে নৌকায় নদী পার হতে হয়। একদিনের ঘটনা, বাবা সরিষাবাড়ি যাবেন, আমিও বায়না ধরলাম বাবার সাথে যাবো। বাবার পেছনে পেছনে যাচ্ছি, আমাদের গাঁয়ের পশ্চিম পাশে চাঁদপুর খেঁয়া-ঘাট। ঘাটে আসা মাত্রই বাবা আমাকে ধরে ফেললেন, শুধু কি ধরা, শুরু হলো আখেরী পিঁটুনী।

খেয়াঁ-ঘাটের মাঝি মাতারপাড়া মুচি বাড়ির বিহারী রবিদাস, তাঁকে আমি মামু করে ডাকতাম। রবিদাস মামু, আমাকে বাবার হাত থেকে রক্ষা করলেন। বসতে দিলেন মামুর বসার জায়গায়। বাবা চলে গেলেন। মামু আমাকে আদর করলেন, কান্না থামালো। শুরু হলো মামা-ভাগনের গল্প। রবিদাস মামুর পরনে ধুতি, গায়ে সেন্টু গেঞ্জি, ঘাড়ে গামছা নেই। মামু পড়েছে লুঙ্গি, মুখ ভর্তি দাড়ি। জানতে চাইলাম মামুর পরিবর্তনের কারণ। মামু সাবধান করলো, ‘যুদ্ধ চলছে পাঁকা সড়কে পাকিস্তানী বিহারীরা চলাফেরা করছে, রাজাকার আলবদররা ক্যাম্প করেছে। আমি হিন্দু, মুচি জাত পরিচয় পেলে আর রক্ষা নাই।’ আমি চুপ। অনেকক্ষন মামুর সাথে কাটালাম। মনে মনে ফন্দি আটলাম, পাঁকা সড়কে যাবো, পাকিস্তানী বিহারী, দেশ শত্রু“ রাজাকার আলবদরদের দেখবো। মামুর খেঁয়া নৌকায় এপার-ওপারের এক পর্যায় ঘাটে ভিড়লো নৌকা। নৌকা থেকে নেমেই ভোঁ-দৌড়, সোজা পশ্চিম দিক ছাতারকান্দি বাসস্ট্যান্ডে। ছোট ছোট জীপ, ভোঁ-ভোঁ করে যাচ্ছে জামালপুরের দিকে। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে দেখলাম।

পিচঢালা পাঁকাসড়ক, প্রখর রোদে জ্বলজ্বল করছে। সড়কের মাঝখানে বসে পড়লাম। হাতে থু-থু লাগিয়ে সড়কের কালো পিসতুলে মারবেলের মত গোটা-গোটা করছি। একটা জীপ পিছনে এসে কড়া ব্রেক কষলো। একটুর জন্য বেঁচে গেলাম। দাড়িয়ে পড়লাম, হতভম্ব! জীপ থেকে নেমে আসলো দুই জোয়ান, সুন্দর চেহারা, বিশাল দেহ, খাকী পোষাক, অনর্গল উর্দু বলছেন, নেমেই আমাকে ধরে ফেললো, কোমর বরাবর এক লাথি, কানে ধরে টেনে তুললো জীপে। গলা আমার শুকিয়ে গেছে, ভয়ে কাঁপছি, পাকিস্তানী বিহারী দেখার জমের সাধ বুঝি এবারই মিটবে। জীপ ছাড়লো জামালপুরের দিকে, ছাতারকান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে ২ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের শেষ সীমান্ত, জামালপুর জেলার প্রবেশ পথেই চুনিয়াবাড়ি ব্রীজ। এই ব্রীজের দুই পাড়ে রাজাকার-আলবদরদের ক্যাম্প। আমাকে এই ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার আমজাদ হোসেন কাছে সোপর্দ করলো বিহারী জোয়ানরা। উর্দুতে কি যেন বললো বিহারীরা। কমান্ডার আমজাদ হোসেন জানালো আমার কোন ক্ষতি হবে না। তবে আমার বাড়ি থেকে কেউ না আসা পর্যন্ত আমাকে ছাড়বে না। দুপুর গড়িয়ে পড়ন্ত বিকাল, ক্ষুধায় পেট চোঁ -চোঁ করছে, খেতে দিল। খাওয়া শেষে আমাকে ক্যাম্পের সামনে একটি বেঞ্চে বসিয়ে দিল। তারা আমাকে বলে দিল, আমি যেন এই রাস্তায় চলা পরিচিত জনদের বলে দেই, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার পরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হলো, কথা হলো চোখে চোখে, মুখ খুলি না। সন্ধা ঘনিয়ে এলো। কমান্ডার জানিয়ে দিল, আমি এ ক্যাম্পেই থেকে যাব। ক্যাম্পের টুকিটাকি কাজ করতে হবে। ক্যাম্পের টুকটাক কাজ দিয়েই শুরু হলো আমার শিশু কালের ঐতিহাসিক চাকুরী জীবন। একদিন যায়, দুইদিন যায়, বাড়ি থেকে কেউ আসে না, আসবেই বা কেন? যদি মেরে ফেলে। তিনদিন অতিবাহিত হচ্ছে। আছরের নামাজের সময় ক্যাম্পের সামনে একটি কাভার্ড ভ্যান থামলো। ভ্যান থেকে নেমে আসলো, পাকিস্তানী বিহারী জোয়ান, কমান্ডার আমজাদ হোসেন এর সাথে উর্দুতে তাদের কথা হলো, এরপর প্রস্তুত হল এই ক্যাম্পের এক রাজাকার। তার একটি চোখ নষ্ট ছিল, তাকে ক্যাম্পের সব রাজাকারই কানা দজ্জাল বলে ডাকতো। দজ্জালের হাতে বন্দুক। একটু পরেই কাভার্ড-ভ্যান থেকে নামিয়ে আনলো কালো কুচকুচে সুদর্শন এক যুবককে। দু হাত পেছনে বাঁধা। চোয়াল বেয়ে রক্ত ঝরছে।

পাকিস্তানী বিহারীদের সাথে স্পষ্ট এবং সাহসী চিত্তে অনর্গল উর্দু বলছে এই যুবক। ভ্যানের পেছনে তাকে বেঁধে ফেললো। সিনেমার স্টাইলে কীক করে তাকে ফেলে দিলো পিচঢালা সড়কে।

দুই রাজাকার এই যুবকের বুকের উপর সোজা দাঁড়িয়ে পড়লো। কাভার্ড-ভ্যান স্টার্ট করলো। আকাশ বিদীর্ন চিৎকার ওমা! ও বাবা! বাঁচাও! এবার কাভার্ড-ভ্যান থামলো। পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি চালালো এই যুবকের বুকে। চোখ আমার বন্ধ। রাতে আর ঘুম হচ্ছে না, স্বচক্ষে মানুষ মারার নারকীয় ঘটনা। এই যুবকের নাম জানতে পারি নাই, তবে সে যে এক মুক্তিযোদ্ধার চাচাতো ভাই, তা জেনেছি কমান্ডারের কাছ থেকে। সকল স্মৃতির একদিন বিস্মৃতি ঘটবে ওই দিনের স্মৃতি কখন ভুলার নয়। সকল ছবিই একদিন মুছে যাবে, মানব ক্যামেরায় বন্দি সাহসী কালো-কুচ-কুচে সুদর্শন এক যুবকের ছবি কখনও মুছে যাবার নয়। ক্যাম্পে অবস্থানের চতুর্থ দিন। আর ভাল লাগছেনা, কমান্ডারকে বললাম, আমি একাই বাড়ি যাবো। কমান্ডার রাজিও হলো, শর্ত দিলো, বাবা-মার সাথে সাক্ষাৎ শেষে দুই-একদিনের মধ্যেই যেনো, আমি আবারও ক্যাম্প ফিরে আসি। কথা দিলাম। রাজাকারই আমাকে দিয়ে গেলো ছাতারকান্দি বাসস্ট্যান্ডে। চলে আসলাম চাঁদপুর খেঁয়াঘাটে। খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আমি বিহারীদের আস্তানা থেকে ফিরে এসেছি। বাড়িতে আসছে লোকজন, জানতে চাচ্ছে কাহিনী। শুনালাম সব ঘটনা। বাড়িতেই অবস্থান করছি। কয়েকদিন কেটে গেলো। ক্যাম্পের দেওয়া শর্তের সময় শেষ।

আমি ঘুমিয়েছি, গভীর রাত। বাবা আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন, নিয়ে আসলেন উঠানে। বাড়িতে এসেছে কয়েক যুবক, পরনে লুঙ্গি, মুখ-মাথা গামছা দিয়ে ঢাকা। এসেই দেখতে পেলাম তাদের। এবার সবাই মাথার গামছা খুললেন। সবাই পরিচিত, আমি গ্রামের অন্য দশজন শিশুর চেয়ে ভিন্ন। দুষ্টামী, লাফা-ঝাফা আমার পছন্দের। সবাই আমাকে ভালবাসেন। পাশের দুই তিন গ্রামের সবাই আমাকে চিনে এবং জানে। আজ যাঁরা এসেছেন তাঁরাও আমাকে প্রচন্ড আদর করেন। শংকরপুরের রইস উদ্দিন, সেকান্দার আলী বাদশা ভাই, হাতেম আলী ও জহুর কাকা। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ১১ নম্বর সেক্টরের আওতায় যুদ্ধ করছেন। আমাকে বিহারীরা ধরে নিয়েছিল, তারা ঘটনা জেনেছেন। এবার আমার কাছ থেকে ঘটনা শুনলো। সবাই আমাকে আদর করলো। আমাকে আবার যেতে হবে রাজাকারদের ক্যাম্পে। থাকতে হবে সেখানে। রাজাকারদের প্রতিদিনের কর্মকান্ড তাদের জানাতে হবে। আমি আর রাজকারদের ক্যাম্পে যাবো না। এই সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিলাম। এবার এই চার মুক্তিযোদ্ধার অনুরোধে, বাবার অনুপ্রেরনা, স্বচক্ষে এক যুবক হত্যার নির্মম ঘটনা আমাকে প্রচন্ড দাগা দেয়। আমি রাজি হলাম, তবে এবার গোয়েন্দাগীরিতে। তাঁরা আমাকে ব্রিফ করলেন, ক্যাম্পের প্রতিদিনের কর্মকান্ড, অপারেশন পদ্ধতি, প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এবং রবিবারে তাদের জানাতে হবে। তারা আসবেন আমার পাশের গ্রাম শংকরপুর বাজারে, আমি আসবো বাড়িতে। যে কথা সেই কাজ, শুরু হলো গোয়েন্দাগীরি। রাজাকারদের প্রায় সকল অপারেশন ভেস্তে যাওয়া শুরু করলো। সাক্সেস হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। অপরদিকে সরিষাবাড়ি এবং মধুপুর থানার ধনবাড়ি অঞ্চলের অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য উৎঘাটনে সহায়ক শক্তি না থাকায় ‘কুচিয়ামোড় ব্রীজে চলছে রাজাকারদের রাম-রাজত্ব। এই এলাকার তথ্য উৎঘাটনের দায়িত্ব নিয়েছে বানিয়াজানের নর-সুন্দর ওই সময়ের তরুণ যুবক, আমার নামে তারাও নাম, জাতে ঢুলি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগের এক পর্যায় ‘মিতা’ গোয়েন্দা আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। সাক্ষাৎ করার কারণ একটাই, আমি তাকে চিনি। সে সেজেছে অর্ধ উলঙ্গ পাগল, তাকে যেতে হবে চুনিয়াবাড়ি ব্রীজে।

কথা হলো কোন অসুবিধা নেই। চলছে যুদ্ধ। দিন তারিখ মনে নেই, শুকনো নদী, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস হতে পারে। দুপুর বেলা, ক্যাম্প ঘেরাও হলো। ভারতের শিখ সৈন্যরা রাজাকারদের ধরে ফেললো, কানা দজ্জাল রাজাকার ছটফট করছে। শিখ সৈন্যরা আমাকে জয় বাংলা বলার জন্য বলে দিলেন, এ খবর যেনো গ্রামে পৌঁছে দেই তাও বলে গেলেন। এক দৌড়ে বাড়ি আসলাম। জয় বাংলা, বাংলার জয় শ্লোগানটি সবার আগে ছড়িয়ে দিলাম গ্রামে। দেশ স্বাধীন। কিছু দিন পর

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন জামালপুরে। আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন পাশের বাড়ি ইয়াদ আলী মন্ডল। জামালপুরে যাওয়ার পর তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা, তরুণ কলেজ ছাত্র সাবেক দিগপাইত শামছুল হক ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আবদুল হামিদ, রাতের বেলায় জামালপুর কথাকলি সিনেমা হলে সিনেমা দেখালেন সাত ভাই চম্পা। এটাই আমার জীবনের প্রথম সিনেমা দেখা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ করে দিলেন। দেখে নিলাম প্রিয়নেতা, জাতির জনক, স্বাধীনতার ঘোষক, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শিল্পী আবদুল জব্বারের কন্ঠে ভেসে আসলো ‘মুজিব ভাইয়া যাওরে………..সাতকোটি বাঙ্গালীর মাঝে মুজিব তুমি নাইয়া।’

লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিক্ষক

মোবাইল: ০১৭১৪-২৫৪০৬৬

ই-মেইল: rahimabdurrahim@hotmail.com