আতিকুর রহমান মানিক

ঈদগাঁহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। আমার মত আরো অনেকের স্বপ্নগুলো বেড়ে উঠার নেপথ্য চারনভূমি। জীবিন-জীবিকার তাগিদে আজ জেলা শহরে স্হায়ী হলেও আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা বৃহত্তর ঈদগাঁওর সমৃদ্ধ এক গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে কোন এক শীতের সকালে আব্বার হাত ধরে ভর্তি হয়েছিলাম স্বপ্নের এ ক্যাম্পাসে। এখানে ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি। একসত্তর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজ উৎসবে মেতেছে প্রিয় প্রাঙ্গন। কিন্তু বিতর্কিত, বেকার, জনবিচ্ছিন্ন ও এরশাদী মনোভাবাপন্ন কতিপয় ব্যক্তি এ মহতী উৎসবের আয়োজক ও মাইক-ব্যাটারী বনে যাওয়ায় এতে অংশ নিইনি। এদের সব কিছুতেই যথেষ্ট অসচ্ছতা। একে প্রকারান্তরে হরিলুটও বলা যায়।

প্রকাশিত ম্যাগাজিনে লেখা সংগ্রহের ক্ষেত্রেও “ঢাক ঢাক-গুড় গুড়” পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন মহা-পন্ডিত ও আঁতেল শ্রেনীর হর্তাকর্তারা। তাই শিক্ষাগুরু, সতীর্থ ও সিনিয়র-জুনিয়রদের অনেকেই এ ম্যাগাজিনে লেখা দিতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে আমরা বসে থাকব কেন ? তাই কিছু স্মৃতিচারনের জন্য আমার প্রিয় ঠিকানা ভার্চুয়াল জগতের আশ্রয় নিলাম। হেড স্যার (সলিম স্যার) ছিলেন বহুগুনে গুনান্বিত একজন শিক্ষক। সে সময় (নব্বই দশকে) বাজারে কয়েকটা  ভিসিআর হল চালু ছিল। দশটাকা টিকেটের বিনিময়ে সেখানে ভিডিওতে ছবি দেখানো হত। স্কুল টাইমে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ছাত্ররা শো দেখত। গুরুতর এ ব্যাপারটা হেড স্যারের চোখ এড়ায়নি। তাই বেত হাতে নিয়ে স্যার মাঝে-মধ্যেই ভিসিআর হলে ঝটিকা অপারেশন পরিচালনা করতেন। এ অপারেশনের পদ্ধতিটাও ছিল জটিল। দ্রুতগতিতে মোটর সাইকেল চালিয়ে ভিসিআর হলের সামনে গিয়ে ভিতরে ঢুকেই বেত দিয়ে এলোপাতাড়ি মার শুরু করতেন স্যার। মারের এ্যাকশন শুরু হলে সবাই পালানো শুরু করত। দরজা ভেঙ্গে, জানালা উপড়ে, চেয়ার মাড়িয়ে কোনরকমে পালিয়ে বাঁচত সবাই। হেড স্যারের এরকম অপারেশন কয়েকবার চলার পর স্কুলের ছাত্রদের আর ভিসিআর হলে ঢুকাতনা।
জ্ঞানতাপস আবদুর রহমান স্যারের পড়ানোর ষ্টাইলটাই ছিল অন্যরকম। ক্লাসে এসে চশমার উপর দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে যে কোন একজনকে পড়া জিজ্ঞেস করতেন। অবধারিতভাবেই সে পারতনা। আসলে স্যার মুখ দেখেই বুঝতেন, কে পড়া শিখে আসেনি। অভিজাত জমিদার পরিবারের সদস্য হয়েও সাদামাটা, সহজ-সরল জীবন-যাপন করতেন নিরহংকার মমতাজ স্যার (ডাঃ  সাইফুদ্দীন ফরাজীর পিতা)। পড়ার সাথে সাথে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন স্যার। জ্যামিতির জটিল সম্পাদ্য-উপপাদ্য কন্ঠস্হ ছিল কড়া মেজাজের বিধু স্যারের। ক্লাসে এসেই চোখ বন্ধ করে ভরাট কন্ঠে পড়া জিজ্ঞেস করতেন তিনি। না পারলে অবধারিত শাস্তি। আমি স্যারকে এতই ভয় পেতাম যে, অনেক সময় জ্যামিতি মুখস্হ করে গিয়েও ক্লাসে বলতে পারতামনা।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর একটা বিষয় প্রায়ই ঘটত। অনেকেই ড্রেস পরে স্কুলে যেতনা। অনেকে আবার লুঙ্গি পরে  প্যান্ট ভাজ করে বইয়ের সাথে নিয়ে গিয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পরে নিত। লুঙ্গি পরে স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটা যদিও আজকাল অকল্পনীয়, তবু আমাদের সময় ব্যাপারটা আকছার ঘটত। এ ব্যাপারটা বর্ষায় বেশী ঘটত। ঐ সময় রাস্তাঘাট আজকের মত পাকা ছিলনা। তাই শীতে ধুলির সাগর পেরিয়ে ও বর্ষায় হাটু পরিমান জলকাঁদা মাড়িয়ে স্কুলে যেতে হত। তাই স্কুলড্রেসের সাদা শার্ট-প্যান্টের অবস্হা হত তথৈবচ। এ জন্য অনেক ছাত্র ড্রেসড আপ হয়ে স্কুলে যেতনা।
ড্রেসের ব্যাপারে কিন্তু অসিত স্যার (বাবু অসিত কুমার পাল) জিরো টলারেন্স মেন্টেইন করতেন। স্যার বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন, তাই দোতলায় বিজ্ঞানাগারেই হত ক্লাসগুলো। এতক্ষন লুঙ্গি পরলেও বিজ্ঞান ক্লাসের আগে সবাই প্যান্ট পরে নিত। আর যারা আনড্রেসড হয়ে ক্লাসে যেত তাদের এক এক করে দাঁড় করিয়ে কৈফিয়ত নিতেন অসিত স্যার। এসময় অপরাধীরা বিভিন্ন অজুহাত দিত, আর স্যার অবস্হা বুঝে মৃদু বেত দিতেন। কিন্তু কাপড় ধোলাই করতে লন্ড্রীতে দিয়েছি বললে আর রেহাই নেই। স্যার বলতেন, তোর মাসিক ইনকাম কত? বেটা, আমি পর্যন্ত নিজহাতে কাপড় ধুই, আর তুই কিনা লন্ড্রীতে ওয়াশ করতে দিস ! এই বলেই বেতানো শুরু। এরপর শুরু হত অনবদ্য পাঠদান। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত  বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো কি সরল ভাবেই না উপস্হাপন করতেন তিনি। স্যারের শাসন-স্নেহ মিশ্রিত ক্লাসগুলো এখন উজ্জল স্মৃতি।
প্রতিদিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে প্যারেড করাতেন গোপাল স্যার। প্যারেডে কেউ বিশৃংখল হলেই বেত দিয়ে মারার ভঙ্গি করতেন কিন্তু মারতেননা কখনো। “এখনো প্রাইমারী স্কুলের গন্ধ যায়নি” অথবা “এই চম্বুলু, ইক্কা অায়” এ দুটি ছিল গোপাল স্যারের স্নেহ মিশ্রিত কমন ডায়লগ। আরো অনেক আলোকিত শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্য পেয়েছি আমরা, এসব আরেকদিন লিখব। স্কুলে সবসময়ই ছাত্রবান্ধব একজন নিবেদিতপ্রান মানুষ ছিলেন, তিনি হলেন দপ্তরী বাবুল দা। সবসময়ই ছাত্রদের পক্ষেই ছিল তার অবস্হান। ক্লাসে পড়া না পারলে স্যাররা তাকে বেত আনতে বলতেন। আর বাবুলদা বেছে বেছে ভাঙ্গা-নষ্ট বেতগুলো আনতেন, যাতে মারটা প্রকট না হয় ! একবার এরকম নষ্ট বেত আনলে এক স্যার রেগেমেগে তাকেই দু এক ঘা বসিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা ক’জন একবার জ্যামিতির পড়া শিখে আসিনি। বিধু স্যারের ক্লাসে পড়া শিখে না যাওয়া মানেই কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হওয়া। তাই আমরা জ্যামিতি ক্লাসের সময়টা বাজারে কাটিয়ে আমরা স্কুলের গেইট দিয়ে ঢুকছিলাম। এমন সময় দোতলায় অফিসের সামনে থেকে হঠাৎ বাঘের হুংকার, “এই সবাই এদিকে আয়” !  এখানে বাঘ ছিলেন বিধু স্যার। (আসলে স্যার ব্যাপারটা টের পেয়ে আমাদের পাকড়াও করার জন্য ওঁৎ পেতেছিলেন)। যাই হোক কয়েকজন গেলেও আমরা দুইজন ভয়ে পালিয়ে গেলাম। বিধু স্যার আমাদের ধরে আনার জন্য বাবুল দাকে পাঠালেন, আর বাবুল দা পড়লেন উভয় সংকটে। অবশেষে অভিনব উপায়ে মুশকিল আসান করলেন তিনি। আমাদের শিখিয়ে দিলেন, আমাদেরকে ধরে স্যারের কাছাকাছি নিয়ে যাবেন আর হাত ছুটে আমরা পালিয়ে যাব, তিনি বাঁধা দেবেননা।
যে কথা সেই কাজ। গেইট পর্যন্ত আমরা হেঁটে হেঁটে বাবুল দার সাথে গেলাম। গেইটে ঢুকার পর বাবুল দা দুই হাতে দুই পিচ্চিকে ধরে স্কুলের দিকে চললেন আর স্যারের কাছাকাছি গিয়েই আমরা আবার পালালাম। পলায়নপর অবস্হায় শুনলাম, স্যার বলছেন “অ বাবুল্যা আঁই বেগ্গিন বুঝি” !
স্কুলের ছাত্রদের প্রিয় টিফিন ছিল “কবিরার চনা”। টিফিন পিরিয়ডে সবাই লাইন দরে কবির ভাইয়ের বিখ্যাত চনা ভাজা খেতাম। প্রতিপ্লেট ১ টাকা দামের সেই চনার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। এখনকার এশিয়া ফার্মেসীর সামনে একটা ঝুপড়িতে বিশাল আকারের হান্ডিতে ভাজা চনাবুট নিয়ে বসতেন কবির ভাই।
এরকম আরো অনেক স্মৃতি আছে ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়কে ঘিরে। আমাদের ক্লাসের প্রায় সবাই ছিল ভীষন ডানপিটে। আসল নামের আড়ালে আরেকটা নামও ছিল সবার। কাউয়া, বলাপিঠা, মটকা, সুপারি, মূলা বিয়ারী, মুরাইল্লা, অট্টিটি, পাইয়্যা বাঁশ ইত্যাদি ছিল আমাদের সহোঠীদের আবিষ্কৃত নিকনেম। আমারও একটা নাম ছিল, বিন্ডি ! গা-গতরে অন্যদের চেয়ে একটু ছোট ছিলাম বলেই এই নাম !
প্রিয় প্রাঙ্গনের প্রাক্তনরা আজ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সু প্রতিষ্ঠিত। সময়ে আবারো হবে স্মৃতিচারন, আজ এ পর্যন্তই।