শহীদুল্লাহ্ কায়সার ॥

সময়টা ছিলো ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন কক্সবাজারে। দুপুরে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-কর্মীসহ সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখবেন। স্টেডিয়ামটি ভেতরে বাইরে তখন লোকে লোকারণ্য। মঞ্চের আশপাশে সরকারি বাহিনীগুলোর কড়া নজরদারি। ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলেই এসএসএফ এর সদস্যরা এসে বাধা দিচ্ছেন।

আমার কাছে সংবাদকর্মীর কার্ড দেখার পর তাদেরই কয়েকজন বললেন, আপনাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে, সেটি মঞ্চ সংলগ্ন বাঁশের যে বেষ্টনি দেয়া হয়েছে, তার বাইরে। শুধু আমি নয়। আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নেতাদেরও মঞ্চ সংলগ্ন এলাকায় যেতে দেয়া হয়নি। ওই সময় উল্টো আমাকেই তাঁদের শান্তনা দিতে হয়। বলতে হয়, শেখ হাসিনা দলীয় প্রধানের চেয়ে বড় কথা এখন তিনি সরকার প্রধান। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সুরক্ষা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।

বলা বাহুল্য এক সময় আমি নিজেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম। অন্য অনেকে ত্যাগী কর্মীর মতোই অত্যন্ত অপমানজনক পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমাকে রাজনীতি ত্যাগ করতে হয়। কক্সবাজার শহরতো বটেই। এখনো উপজেলাগুলোতে গেলে আমাকে বয়ে বেড়াতে হয় রাজনীতির পরিচয়। সম্মুখীন হতে হয় নানান প্রশ্নের।

আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা এখনো বিশ^াস করতে পারেন না, আমি রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি। তাঁরা দেখেছে একসময় রাজনীতিই আমার ধ্যান, জ্ঞান ছিলো। এ কারণেই মনে হয় বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিলেই চলে আসে রাজনীতির প্রসঙ্গ। বেশ কয়েকবার অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গেই তাঁদের বলেছিÑ টাকা, বেশ্যা, মদ আর জুয়ার টেবিল যেখানে রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। এগুলোই রাজনীতির ভাষা। সেখানে আমাদের মতো কর্মীদের প্রস্থান স্বাভাবিক। আমি বিষয়টিকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। যদি রাজনীতি করতে চান, খুব ঠা-া মাথায় এসবের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে। নইলে রাজনীতি ছেড়ে দেন।

তাঁদের কয়েকজন তো আমাকে রীতিমতো আকাশে তুলে ফেলে অবস্থা। মাঝে মাঝেই বলে, শহীদুল্লাহ্ ভাই (বড়রা অবশ্য আমাকে শহীদুল্লাহ্ আমাকে ডাকে, অনেকের কাছে আমি আবার কায়সার নামে পরিচিত) আপনি রাজনীতি ছেড়ে দেয়ায় ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হবেন। তবে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমার উত্তর শুনে অবশ্য তাঁরা অবাক হয়। আমি রাখঢাক না রেখেই বলি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনে আমার মতো শহীদুল্লাহ্ দুই একটা না থাকলে কিছু হবে না (মাঝে মাঝে রাজনীতির ইতিহাস আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়)। এসব গাঁজাখুরি চিন্তা বাদ দিয়ে যেদিকে লাভ সেদিকে চলো। নীতি কথা ফেলে রেখে বাস্তবতাকে মেনে নাও। নীতির রাজনীতির অনেক আগেই কবর রচিত হয়েছে। সেসব বিষয় আমার এই লেখার প্রতিপাদ্য নয়।

দুপুরের দিকে হঠাৎ আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার ইশারায় এসএসএফ সদস্যরা আমাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। সেখানে গিয়ে দেখা মিললো কক্সবাজার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মুহিদুল্লাহ্র। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি না হয় সংবাদকর্মী হয়ে প্রবেশ করলাম। কিন্তু আপনি কিভাবে এখানে এলেন। আপনার দলীয় পদবী তো এখানে আসার জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি বললেন, কায়সার চুপ থাকো। আমি এখানে ব্যান্ড দলের ঢুল বাদক হিসেবে এসেছি। এ কারণে কার্ড দেখাতে লজ্জা লাগছে। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে এক বোতল মিনারেল ওয়াটারের ব্যবস্থা করে দিলেন।

কিন্তু বিধিবাম। যে স্থানে বসেছিলাম, সেটি ছিলো সংরক্ষিত। সরকারি উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের আসন হওয়ায় আমাকে অন্য একটি জায়গায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। সেখানে গিয়ে দেখলাম, স্থানটি আগেরটির চেয়ে অনেক উন্নত। গিয়েই সরাসরি একটি চেয়ারে বসলাম। দেখা মিললো কয়েকজন পরিচিত সহকর্মীর।

এর একটু পরেই এক ভদ্রলোক আমার পাশে এসেই হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি অত্যন্ত লজ্জিত চেহারায় হ্যান্ড শেক এর পরিবর্তে প্রথমে তাঁকে দাঁড়িয়ে সম্মান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, আপনি আমাকে কিভাবে চিনলেন? আমি মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভুঁইয়া। উত্তরে আমি বললাম, আমি আপনাকে চিনি। এরপর দীর্ঘক্ষণ ধরে তাঁর একটিই প্রশ্ন ছিলো। আমি তাঁকে কিভাবে চিনি। এর উত্তর দেয়া একদিকে যেমন বিব্রতকর অন্যদিকে আমার পক্ষে মিথ্যা বলাটাও ছিলো কষ্টকর। ফলে কৌশলে বিষয়টি আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু তিনি আমাকে কিছুতেই ছাড়বেন না। আমাকে বলতেই হবে, আমি তাঁকে কিভাবে চিনি।

একপর্যায়ে বলতে বাধ্য হলাম, পুরুলিয়ার ঘটনার পরই আমি আপনাকে চিনি। শুধু আমি নয় সারা বিশে^র মানুষের কাছে আপনার নামটি পরিচিত হয়ে উঠে। আমার ধারণাই সত্যি হলো। তিনি হয়তো আমার এ ধরনের উত্তর প্রত্যাশা করেননি। কিছুক্ষণের জন্য তাঁর চেহারার লাবণ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। আমাকে বললেন, বিষয়টি বলে আমাকে লজ্জা দিবেন না। আসলেই ওই ঘটনায় আমার কোন হাত ছিলো না। আমি শুধুমাত্র একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলাম। এর বাইরে কিছুই করিনি। এরপরই আমি তাঁকে বললাম, স্যার আপনাকে বিব্রত করতে আমি এই কথা বলিনি। আমি আপনাকে কিভাবে চিনলাম শুধু সেটি বলার চেষ্টা করেছি। এরপর বেশ কিছুক্ষণ মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভুঁইয়ার সঙ্গে কথা বললাম। (চলবে)