এইচ এম আবু ছিদ্দিক :

সৃষ্টির সুচনালগ্ন থেকেই মানুষের জীবনযাত্রা সহজ থেকে সহজতর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রাদি তৈরী বা আবিষ্কারের দিকে অগ্রসর হতে হয়েছিল। সে কারণেই বলা হয়ে থাকে যে, প্রয়োজনীয়তাই আবিষ্কারের জন্মদাত্রী। কোন কিছুর অভাব বা অপ্রাচুর্যতাবোধকে দুরীকরণে কেউ কেউ ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে আবিষ্কারের মাধ্যমে ঐ অভাব বা অপ্রাচুর্যতাবোধের শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন। অবশ্য অনেকেই তা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন যে, অনেক কিছুর অভাবের প্রেক্ষাপটেই একটি আবিষ্কারের জন্ম হয়। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনসহ বেশ কিছু বিজ্ঞানীদের জ্ঞানগর্ভভিত্তিক প্রযুক্তির আবিষ্কার মানুষের জীবনমান অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। যুগোপযোগী প্রযুক্তির আবিষ্কার ও সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আরও সহজ হতে পারে, এতে কোন সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অর্থশাস্ত্র পাঠচক্র বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি ও উন্নয়ন নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করেন। প্রধান বক্তা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনির্ভাসিটি অব ইলিনয়ের (স্প্রিংফিল্ড) ইমেরিটাস প্রফেসার বাকের আহমদ সিদ্দীকী। সে প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। প্রযুক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে দ্রুত একটি অতি-উৎপাদনশীল প্রাচুর্যময় বিশ্বের সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশের মধ্য দিয়ে মানুষ এমন সুলভ ও নিরাপদ বিদ্যুতের দিকে যাচ্ছে। যাতে প্রান্তিক ব্যয় শূন্যের কাছাকাছি চলে যাবে। প্রযুক্তির বিকাশে বহু বাজারের পণ্যের জোগান এতই বেশী হতে থাকবে যে, তার বিনিময়মূল্য প্রায় শূন্যের কোটায় দাঁড়াবে। কিন্তু মানুষের এই বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা বন্দী হয়ে আছে একচেটিয়া বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে। তাদের মুনাফা যেখানে নেই বা যে প্রযুক্তির বিকাশে তার মুনাফা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, তাকে সে পেটেন্ট করে আটকে রাখে। প্রযুক্তি নিয়ে যায় ধ্বংস ও অপ্রয়োজনীয় ভোগ আর অপচয়ের দিকে। যে প্রযুক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ নিজেদের ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলতে পারে। তাকে লাগানো হয় মানুষে মানুষে বিবাদ, হিংসা আর বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে। যে প্রযুক্তি মানুষকে দিতে পারে অপার স্বাধীনতা, তাকে কাজে লাগানো হয় অবিরাম নজরদারি আর মানুষকে শৃঙ্খলিত করার কাজে। বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও মস্তিষ্কের ক্ষমতার খুব কম অংশই এখন পর্যন্ত কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। আরও অনেক ক্ষমতা কাজে লাগানোর অপেক্ষায়। প্রতিটি মানুষই তাই অসীম ক্ষমতাধর। অথচ বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা, নির্যাতন ও অপমানের শিকার। প্রযুক্তি বিকাশে আসল বুদ্ধিমত্তার মানুষ গুরুত্ব পেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্রসহ সব প্রযুক্তির বিকাশ দুনিয়াকে সত্যিই আনন্দময় করতে সক্ষম হবে। তবে সেই ক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে জগৎটা মানুষের হাতে থাকতে হবে। (সূত্র: প্রথমআলো) বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন কিছু বুদ্ধিজীবিদের উচ্চ বিলাসিতা ও প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে পরিকল্পিত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ গ্রামীণ স্কুলে বাথরুম, দরজা-জানালা, বিশুদ্ধ খাবার পানি, বিদ্যুৎ সমস্যাসহ দপ্তরী ও শিক্ষক সংকট যেখানে দৃশ্যমান। সেখানে কিছু নির্দ্দিষ্ট স্কুলে হাজার কোটি টাকার চলন্ত সিঁড়ি (স্কেলেটর) শিক্ষার্থীদের অলস ও কর্মাক্ষম বানানো ছাড়া কোন কাজে আসবে বলে আমার মনে হয়না। এর ফলে অধিকাংশ তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানষিক বৈষম্য বাড়বে। ঐসব স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য অভিভাবকদের সাথেও প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব লেগেই থাকবে। এরকম শত শত অপরিকল্পিত প্রকল্পের উদাহরণ দেয়া যায়। তথ্যপ্রযুক্তির আরেক নকল পণ্যে কদরের প্রদর্শনী ২০১৭ শেষ হলেও পুরাপুরি রেশ এখনো কাটেনি। শহরে কিংবা গ্রামে কথিত রোবটমানব সুফিয়া প্রসঙ্গ নিয়ে যুক্তিতর্ক চলছে। সুফিয়াকে আনার পিছনে একটু বেশী খরচ হলেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক বলেছে, টাকা-পয়সা কোন সমস্যা নয়। দেশের তরুণ সমাজকে প্রযুক্তিতে উৎসাহ দেয়ার লক্ষ্যে রোবট সুফিয়াকে আনা হয়েছে। অথচ এর আগে স্বদেশে মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রোবট তৈরী করেছে। সেই বন্ধু রোবটের ভিডিও ফুটেজ ইউটিউবে অনেকবার দেখেছি। তাদের অভিযোগ বিদেশী রোবট সুফিয়ার চেয়ে স্বদেশীয় তৈরী বন্ধু রোবটটি অনেক উন্নত এবং বাংলায় কথা বলতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, বিদেশী রোবট সুফিয়া দেশের তরুণ সমাজের কাছে যথাযোগ্য প্রযুক্তি কিনা? নাকি দেশের টাকায় বিদেশী নকল পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যস্ত ক্ষমতাসীন বুদ্ধিজীবিরা। অবশ্য জুনাইদ আহমদ পলক কথিত রোবটমানব সুফিয়ার কাছ থেকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে কম জ্ঞানবুদ্ধি নেননি। আগামীতে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বানানোর প্রচেষ্টার কথাও একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে জানিয়েছেন। এসব নকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে কি করবে, এবং কোথায় বাজারজাত করবে? বিষয়টি দেশের জনগণের কাছে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তাঁর এই গবেষণার পিছনে দেশের প্রচুর টাকা বিদেশে চলে যাবে। সেই টাকাগুলো আর কখনো দেশে ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ডিজিটেল বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক যুগে বিদেশী নকল প্রযুক্তির কদর যখন এতই বেশী। তখন এদেশের সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ বেড়ে যায়। নকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গবেষণার অজুহাতে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা? তবে আমার মতে সেই টাকাগুলো দিয়ে দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আসল মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কাজে লাগানো যায় কিনা ভেবে দেখার বিষয়। বিদেশ থেকে বাক্স ভরে আসা সুফিয়া নাকি মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পেয়েছে। উন্নয়নের রোলমডেল বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। বিভিন্ন ডিভাইস ও সফটওয়্যারের সমন্বয়ে রেডি করে মঞ্চে আনা সুফিয়াকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটেল বাংলাদেশ ও নিজ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। সুফিয়াও প্রধানমন্ত্রীকে মাদার অব হিউম্যানিটিসহ ডিজিটেল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠান উদ্বোধনের অনুরোধ জানান। দেশের প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, আসল বুদ্ধিমত্তার মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে রোবটের ক্ষমতা কল্পনা করাটাও অবান্তর। তাদের মতে অনুষ্ঠানে রোবট সুফিয়ার পুরো বিষয়টি আশেপাশের বুদ্ধিজীবিদের সাজানো নাটক। দেশের একজন সর্বোচ্চ ব্যক্তি যখন কারো পাতানো ফাঁদে পা দেয়। তখন এদেশের আসল বুদ্ধিমত্তার মানুষের হতাশার যৌক্তিকতাও জোরালো হয়। বাংলাদেশে কিছু দূর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের কারণে রাষ্ট্র এবং জনগণের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরী হয়েছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। না পারছে জনগণ সরকারকে, না সরকার জনগণকে। এই সমস্যা দ্রুত সমাধান নাহলে স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের মান রক্ষা করা কঠিন হবে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার প্রতিবেশীরা স্বাধীন দেশের ভূখন্ড অতিক্রম করেছে। অতীতের সব ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন বছরের প্রথম কাজ হবে, স্বাধীনতার চেতনা স্থাপন করা। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাস্তবায়নে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাকেই উদ্যেগ নিতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বাণী।

মোবাইল:- ০১৫৫৮৩৬৩৩৪৩