ডাঃ মোহাম্মদ লোকমান::

আমাদের দেশে বহুল পরিচিত একটি জীবনঘাতী মারাত্মক সংক্রামক রোগের নাম ‘নিউমোনিয়া’।
বলতে গেলে এই রোগের নাম শুনেননি এমন লোক এদেশে নাই বললেই চলে। বিশেষ করে শিশুর মা-বাবার কাছে এটি একটি বড় আতংকের নাম।
কারন এদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারন হচ্ছে এই নিউমোনিয়া।

নিউমোনিয়া কি?
নিউমোনিয়া হচ্ছে ফুসফুসের প্রদাহ জনিত একটি সংক্রাম রোগ। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক কিংবা যেকোন ধরনের পরজীবী সংক্রমণের কারনে এই রোগ হয়। এই রোগ হলে শরীরে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের স্বাভাবিক আদান প্রদান প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।

কিভাবে ছড়ায়?
এটি একটি বায়ু বাহিত সংক্রামক রোগ।
আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নিউমোনিয়ার জীবানু সহজেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিশ্বাসের মাধ্যমে এই জীবানু সুস্থ মানুষের শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে ফুসফুসে সংক্রমন ঘটায়।

নিউমোনিয়ার উপসর্গ
সাধারণ সর্দিকাশি দিয়েই নিউমোনিয়ার লক্ষণ শুরু হয়।
শিশুর বয়সভেদে রোগের উপসর্গেও তারতম্য দেখা দেয়। শিশুর নিউমোনিয়া হলে যেসব লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যেতে পারে :
প্রচণ্ড জ্বর, কাঁপুনি
কাশি, সর্দি,
দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস,
শ্বাসে শাঁ শাঁ শব্দ,
শ্বাস কষ্ট (নাসারন্ধ্র ফুলে ফুলে ওঠা,
দ্রুত পেট ওঠা-নামা, পাঁজরের মাংশপেশি দেবে যাওয়া)
নির্জীব হয়ে পড়া,
দুধ চুষে খেতে না পারা,
ঠোট ও আঙুলের নখ ধূসর অথবা নীলাভ রং ধারণ করা,
বমি, পেট ব্যথা,
বুক ব্যথা, ইত্যাদি।

নিউমোনিয়া কাদের হয়?
সব বয়সেই নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে ৫ বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের মধ্যেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। দেখা গেছে, যেসব বাচ্চা –
অপুষ্ট হয়ে জন্ম নিয়েছে,
কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে,
ঠিকমত বুকের দুধ খায়নি,
সময়মত টিকা নেয়নি,
ঘন বসতি, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে বাস করে,
যে ঘরে বড়রা ধুমপান করে- তাদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশি হয়।
এছাড়া বয়স্কদের বিশেষ করে যাদের ডায়েবেটিস, হাঁপানি কিংবা দীর্ঘমেয়াদী কোন রোগ থাকার কারনে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে, তারা অতি সহজেই নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হতে পারে।

নিউমোনিয়া হলে কি হয়?
বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণ এবং শরীরের অপ্রয়োজনীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে দেওয়াটাই হলো শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রধান কাজ। নিউমোনিয়ার কারনে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে বাতাসের এই আদান প্রদান বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে অক্সিজেন পাওয়া থেকে শরীর বঞ্চিত হয় এবং বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শরীরে জমা হয়; যা দ্রুতই মস্তিস্ক, হৃৎপিন্ড, কিডনি ইত্যাদিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বাচ্চাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।

শিশু কি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত?
জীবাণু দ্বারা শ্বাসনালি আক্রান্ত হলেই কাশি এবং জ্বরের সাথে শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পায়।
এই শ্বাসের গতি ২ মাসের কম বয়সী শিশুদের ৬০;
২ মাস থেকে ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৫০;
১ বছরের বেশি এবং ৫ বছরের নিচের শিশুদের প্রতি মিনিটে ৪০ বা তার চেয়ে বেশি হলে আমরা তাকে নিউমোনিয়ার কারণেই দ্রুত শ্বাস হিসেবে ধরে নিই।
জ্বরের সাথে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট শুরু হলেই তাকে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কাশির সাথে জ্বর বা উল্টো ঠান্ডা হয়ে গেলেও শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
আবার ২ মাসের কম বয়সী শিশুদের নেতিয়ে যাওয়া, খিঁচুনি হওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা খেতে না পারার লক্ষণ থাকলে দ্রুত ডাক্তার বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

নিউমোনিয়ার চিকিৎসা:
লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথেসাথে দেরী না করে শিশুকে নিকটস্থ হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সঠিক সময়ে দ্রুত চিকিৎসা পেলে এই রোগ হতে পুরোপুরি আরোগ্যলাভ সম্ভব।
প্রাথমিক পর্যায়ে তুলনামূলক ভাবে কম সংক্রমিত নিউমোনিয়ার বাচ্চাকে বাড়িতে রেখেই ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চিকিৎসা করানো সম্ভব।
এক্ষেত্রে বাচ্ছাকে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসে আরামে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বাচ্চার খাবার এবং শরীরের পানির পরিমাণ ঠিক রাখতে হবে। নাক যেন বন্ধ না থাকে, সবসময় খেয়াল রাখতে হবে।
মারাত্মক নিউমোনিয়ায় রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে।

নিউমোনিয়া প্রতিরোধে করনীয়:
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
শিশুর নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে শিশুর মা।
-জন্মের ১ ঘন্টার মধ্যে শিশুকে শালদুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে যাহা নিউমোনিয়া প্রতিরোধে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত ভ্যাকসিন হিসেবে কাজ করবে।
-জন্মের প্রথম ছয় মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাস পর বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
-বাড়ির সকলকে অবশ্যই দিনে কয়েকবার সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। বিশেষ করে বাহির হতে ঘরে আসার পরপর এবং বাচ্ছাকে কোলে নেয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে।
-গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের যথাযথ যত্ন নিতে হবে যাতে অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম না হয়।
-কোন শিশু অপরিণত বয়সে বা স্বল্প ওজন নিয়ে জন্ম নিলে তাদের ব্যপারে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে।
অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম থাকে। তাই যথাযথ পুষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে।
-শিশুকে সময়মত সরকারিভাবে প্রদত্ত সবগুলো টিকা দিতে হবে।
-ঠাণ্ডা-কাশিতে অথবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী থেকে দূরে রাখতে হবে।
-শিশুর থাকার জায়গা এবং বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
-বাড়িতে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
-শিশুকে সিগারেট বা চুলার ধোঁয়া থেকে দূরে রাখতে হবে।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।
শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের মাধ্যমে নিউমোনিয়া সহ যাবতীয় সংক্রামক রোগ হতে অনেকাংশে দূরে থাকা সম্ভব।
আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি জানার এবং মানার তাওফিক দেন!।

-লেখক: মেডিকেল অফিসার, চকরিয়া পৌরসভা, কক্সবাজার।