জীবন মুখী গান

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর, ২০২০ ০৯:৩২

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন:
নুতন রীতি , গান অথবা জীবনমুখী গান কি বাংলা গানের জগতে নুতন যুগ তৈরী করবে, নুতুন রীতির বাংলা অথবা যাতে বলা হচ্ছে চলতি ভাষায় জীবনমুখী বাংলা গান, সেই গান নিয়েই ইতিমধ্যে আলোচনার ঝড় উঠেছে।

হেমন্ত, লতা, মান্না যে আধুনিক বাংলা গানের ধারা তৈরী করেছেন এখনও তা সর্বক্ষেত্রেই জনগনকে মাতিয়ে রেখেছে। এখন প্রশ্ন এই তথাকথিত জীবনমুখী গানের স্থায়িত্ব কতটা! প্রশ্নটির বিস্তারিত বিশ্লেষনের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদেও খুজে দেখতে হবে নুতন রীতির বাংলা গান তথা জীবনমুখী গানের বৈশিস্ট কোথায়? আধুনিক বাংলা গানের সাথে এর পার্থক্য কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর বড় কঠিন । সমালোচক কিংবা পন্ডিতরা এই গানের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে ভালমন্দ দিকগুলো নিখুতভাবে তুলে ধরতে পারেন।কিন্তু দায়িত্ব সম্মন্দে ফতোয়া জারি করতে পারেন না। আমরা জানি নানা শাস্ত্রীয় গানের ঘেরা টেপ থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক বাংলা গানের সৃস্টি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তীকাল্ এই আধিুনিক গানই রবীন্দ্রনাথের গান বলে আমাদের কাছে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ যে ধারার রুপকার সেই ধারার একটি অংশ যা আধুনিক বাংলা গান নামে পরিচিত । সে গান ষাটের দশকে এমনকি ৭০ এর দশকে আপন ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলে।

হেমন্ত , মান্না লতার পর নতুন প্রজস্মেও কোন সম্ভাবনার শিল্পী চোখে পড়েনা। একথাটা যেমন গায়ক শিল্পীদেও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অনুরূপভাবে গীতিকার ও সুরকারদেও ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

নুতন গায়ক গায়িকারা বলে বেড়াচ্ছেন . তারা নাকি তাদের গানে সময়কে ধরে রেখেছেন। এ প্রসংগে কাজী নজরূল ইসলামের একটা উক্তি খবই তাৎপর্যপুর্ন বলে মনে হচ্ছে। তিনি একবার বলেছিলেন , কিছুটা আক্ষেপকরেই বলেছিলেন, ”আমি হুজুগের কবি , আমি সময়ের কবি”। অর্থাৎ যে লেখার মধ্যে সময়কে ধরে রাখার প্রয়াস সে লেখা সে কাব্য, সে কবিতা কখনও সময়োত্তির্ন হতে পারেনা। বাংলা গানের আগেকার শিল্পীরা তাদেও গানে হৃদয়কে প্রাধান্য দিয়েছিল বলে তাদের গান আজও অম্লান। জীবনমুখী গায়করা যদি মনে করেন তারাই তাদেও জীবনমুখী গানে সময়কে ধওে রাখতে সক্ষম তা হলে তা সর্বাগ্রে ভুল হবে। কারন তাদেও অগ্রজ কবি গীতিকার তাদেও কালজয়ী অসংখ্য গান এবং কবিতায় সময়কে ধরে রেখেছেন। যেমনঃ- বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলনকে গিরে রবীন্দনাথ লিখেছেন ”বাংলার মাটি বাংলার জল” দ্বিজেন্দ্রলাল লিখেছেন ’ এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবেনাকো তুমি”। হেমচন্দ্র লিখেছেন” বাজোওে শিঙ্গা বাজো” রজনীকান্ত লিখেছেন” মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই”। নজরুল লিখেছেন,” কারারঐ লৌহ কপাট” ইত্যাদী এই গান গুলি এখ নও আমাদেও শরীরে শিহরন জাগায় । অতীতকে তুলে এনে বসিয়ে দেয় আমাদেও চোখের সামনে।শুধু কি এরাই? সলিল চৌধুরী, ভুপেন হাজারিকা, হেমাঙ্গ , সনধ্যা জগন্ময়, ধীরেনদাশ , ভবানী, সত্য চৌধুরী প্রমুখ গায়কদেও সামনে সময় কি ধরা পড়েনি?

কিন্তু সেই অর্থে আজকের সুমন , নচিকেতা, অঞ্জনদ্ত্ত, শিলাজিত, পল্লব , প্রসেনজিৎ এদের গানে সময়ের যে প্রতিফলন দেখা যায় তার গুরুত্ব কতটুকু? ঘটনা তার গুরুত্ব বিচারেই ইতিহাসে স্থান পায়। এরা তো ঘটনাকে সময়ের প্রতীক হিসাবে গানের মধ্যে স্থায়িত্ব দিতে চাইছেন তার গুরুত্ব কিনতু খুবই সামান্য। প্রতাহিক জিবনের খুটিনাটি, সুখ দুঃখ এর অবশ্যই একটা মুল্য আছে। কিন্তু এরা সময়ের নামে যা ধরে রাখতে চাইছেন ; সেটা দৈনন্দিন জীবনের বাজার দর ছাড়া আর কিছুই নয়।”এই বাজার দরটা খুবই ক্ষনস্থায়ী। আজ এখানে আছে , কাল তার অবস্থান প্রতিক্রিয়াশুন্য হতে বাধ্য।

উপরন্তু এই সব নব প্রজন্মেও কন্ঠে প্রায়ই শোনা যায় পুর্বসুরীদের অস্বীকার করার প্রবনতা। পরস্পরকে শ্রদ্বাকরতে না পারলে নুতন কিছু যে সৃস্টিকরতে পারা যায়না।এই শিক্ষাটা তথাকথিত জীবনমুখী গায়কদের নেই।আরও একটা কথা কথায় কথায় আংরি ইয়ংম্যান, এর ইমেজ নিয়ে কথায় কথায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়াটা যেনো এই গায়কদেও একটা অভ্যাস ।

সুরের কথাই ধরা যাক। জীবনমুখী গায়কদের বেশীর ভাগই সুর বিদেশী গানের থেকে নেওয়া। বব ডিলান, এলভিস প্রিসলি, মাইকেল জেকসন ইত্যাদী । এপ্রসঙ্গে সুমনের গানের কলি তুলে ধরা যাক, I want you, I need you, I love you, এলভিস প্রিসলির গানট্ সুমনের গানের সাথে মিলিয়ে দেখুন ”” প্রথমত আমি তোমাকে চাই শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই” তাছাড়া রেপ গানের নকল তো অহরহ হচ্ছে।

বাংলা গানে বিদেশী সুরের প্রভাব নিয়ে আগেও অনেক আলাপ হয়েছে।বিতর্ক এবং নানা প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে সকলে ভুল করে আসছেন।সেটা হচ্ছে প্রভাব, নকল , আত্মীয়করন। এই তিনটি শদ্বকে তারা একই সরল রেখায় বসিয়ে বাংলা গানে বিদেশী সুরের প্রভাব ব্যাপারটা বিচার করছে। ফলে সব কিছু এলো মেলো হয়ে গেছে। সৃস্টি হয়েছে ভুল বুঝাবুঝির। পৃর্বসুরীদের গানে বিদেশী সুরের যে প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, সেখানে বিদেশী সুরকে সাদেশিকতার ন্যায় আত্মীকরনের একটা ব্যাপার ছিল। এই আত্মীকরন ও নকল এক জিনিষ নয়।

আজকাল জীবনমুখী গানের গায়করা অভিযোগ করেন,”আমরা বিদেশী সুর নকল করলে যত দোষ অথচ রবীন্দ্রনাথ, দিজেন্দ্রলাল , নজরূল ,এদের গানে তো বিদেশী গানের প্রভাব পাওয়া যায়।তখনতো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়না। আত্মীয়করন ও নকল শদ্ধ এক নয়। রবীন্দ্রন্থা তো নিজেই বলেছেন, পুরানো সেই দিনের কথা , বিদেশী লোক সংগীতের সুরের প্রেরনায় সৃস্টিকরা হয়েছে। কিন্তু কে বলবে এই গান বিদেশী সুরের প্রভাবে সৃস্ট? কে বলবে , কে বলবে রীন্দ্রনাথের এই গানটি ভারতীয স্ংগীতের ঐতিহ্য ধারা থেকে বিচ্যুত? আসলে এ কেই আমরা বলেছি আত্মীয়করন। এই আত্মীয়করনের পরিচয় মেলে সলিল চৌধুরী, হেমন্ত, মান্না, অতুলপ্রসাদ এর কিছু কিছু গানে। আর আত্মীয়করন তার পক্ষেরই সম্ভব যিনি সংগীতকে গুলে খেয়েছেন। যিনি গানের ভিতর ঢুকতে পেরেছেন।

নুতন প্রজন্মের গায়কদের বিরোদ্ধে একটা অভিযেগ শোনা যায়, তারানাকি যথাযথ তালিম ব্যতিরেকে গানের জগতে ঢুকে পড়েছেন। অনেকে বলেছেন হাতে গিটার, একমুখ দাড়ি,পরনে ফটপফটু জিনস্, গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি, আবৃত্তির গলাটা একটু সুরেলা থাকলেই আজকের জীবনমুখী গায়কের সার্টিফিকেট পাওয়া যায।