বিদেশ ডেস্ক:
মিয়ানমারে পূর্ণাঙ্গ সেনাশাসনের অবসানের পর রবিবার (৮ নভেম্বর) দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে অং সান সু চি’র ‘জনপ্রিয়তা’ বিবেচনায় তার দল এনএলডি আবারও ক্ষমতায় আসবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জনগোষ্ঠী সু চিকে জাতির মাতা হিসেবে বিবেচনা করে। গত বছর হেগের আদালতে ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা’র অভিযোগ প্রশ্নে মিয়ানমারের পক্ষে সাফাই গাওয়ার পর দেশের ভেতরে তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে। তবে জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ক্রমাগত বাড়ছে অনীহা। গভীর হচ্ছে ক্ষোভ। নিপীড়িত রোহিঙ্গাসহ প্রায় ২৬ লাখ সংখ্যালঘুকে ভোটাধিকারবঞ্চিত করে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ নির্বাচন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো আভাস দিয়েছে, এর মধ্য দিয়ে সু চি হয়তো জয় পেতে যাচ্ছেন ঠিকই, তবে রোহিঙ্গাদের নিপীড়িত বাস্তবতা বয়ে বেড়ানোর সে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

নোবেলজয়ী অং সান সু চি ও তার দল এনএলডি ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করে। ৫০ বছর ধরে সামরিক শাসনে থাকার পর মিয়ানমার পায় প্রথম বেসামরিক সরকার। মিয়ানমারের মানুষ আশা করছিলো দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রে রূপান্তরের এ ধারাকে সু চি এগিয়ে নিয়ে যাবেন। পাঁচ বছর পর জাতিগত বামার গোষ্ঠীর কাছে সু চি’র জনপ্রিয়তা একইরকম থেকে গেছে। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সু চি এখন আর গণতন্ত্রে আদর্শ বলে বিবেচিত হন না। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সেনাবাহিনীর চালানো নিপীড়নের ব্যাপারে তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) অভিযুক্ত হয়েছে মিয়ানমার।মিয়ানমার বরাবরই গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। দেশটির দাবি, পুলিশ পোস্টে হামলাকারী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বৈধ অভিযান চালিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। দেশটির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ও রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি’ও রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোনও ইতিবাচক ভূমিকা নিতে সক্ষম হননি। বরং গণহত্যাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতেও কোনও উদ্যোগ নেননি সু চি। বরং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার কোনও অগ্রগতি না হওয়ার দায় বাংলাদেশের ওপর চাপিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয়ও অস্বীকার করে আসছেন তিনি। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিতর্কিত হয়েছেন এক সময়ের গণতন্ত্রপন্থী এই নেত্রী। হারিয়েছেন বহু সম্মাননা।

যেসব রোহিঙ্গা এখনও রাখাইন ছাড়েননি, তাদেরকে অনবরত বন্দিশালার মতো পরিস্থিতিতে থাকতে হচ্ছে। তাদের চলাফেরায় স্বাধীনতা নেই, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা নেওয়ারও অধিকার নেই তাদের।

প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এবারের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এর মধ্যে ৫০ লাখই তরুণ ও প্রথমবারের ভোটার। এনএলডি-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ৯০টি দল। সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ১৫ লাখ ভোটারকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কথা বলে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। ভোটাধিকার বঞ্চিত হওয়া এ ১৫ লাখ মানুষের মধ্যে এমন অনেক রাখাইন বৌদ্ধও রয়েছেন, যারা ২০১৫ সালে ভোট দিতে পারলেও এবার পারছেন না। এর পাশাপাশি ভোটাধিকারবঞ্চিত ১১ লাখ রোহিঙ্গাও রয়েছেন, যারা কিনা দীর্ঘদিন ধরেই নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।

ফরটিফাই রাইটস-এর জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ জন কিনলি বলেন, বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার দেওয়া হচ্ছে না শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা রাজনৈতিক দলগুলোকেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হচ্ছে না। শুধু জাতিগত পরিচয়ের কারণে এসব সাহসী, বুদ্ধিদীপ্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হচ্ছে না।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। নির্বাচনকে ‘মৌলিকভাবে ত্রুটিযুক্ত’ বলে উল্লেখ করেছে তারা। সংঘাত কবলিত এলাকাগুলোতে অনেক কমিউনিটির মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। সম্প্রতি সেনাপ্রধান এক বিরল সাক্ষাৎকারে তার ক্ষমতার কথা উচ্চারণ করেছেন। অভিযোগ করেছেন, বেসামরিক সরকার নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘অগ্রহণযোগ্য ভুল’ করছে। কমান্ডার ইন চিফ মিং অং হ্লায়াং সেনাবাহিনীকে দেশের ‘অভিভাবক’ বলে উল্লেখ করেন।

নির্বাচন নিয়ে অনীহা বেড়ে যাওয়ায় এবার ভোটার সংখ্যা ২০১৫ সালের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণেও অনেকে ভোট দিতে অনাগ্রহী হতে পারেন।

মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে অল বার্মা ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস ইউনিয়নস। রয়টার্সের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে সংগঠনটির সদস্যদের কাউকে কাউকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হচ্ছে। পালিয়ে আছেন বেশ কয়েকজন।

মিয়ানমারে ব্যাপক আকারে জাতিগত বিভাজন, রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘুদের প্রতি বঞ্চনা এবং সামাজিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দমনমূলক পরিবেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক রূপান্তর হবে বলে তারা আর আশাবাদী হতে পারছেন না।

ফরটিফাই রাইটস-এর জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ জন কিনলি বলেন, ‘সু চি ও তার দল এনএলডির জন্য হানিমুন অধ্যায় শেষ হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে।’

দ্য কনভারসেশন ডট কম এক প্রতিবেদনে একটি অংশের শিরোনাম করেছে “অধিকারহীন গণতন্ত্র”। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে রোহিঙ্গা ইস্যুকে আড়ালেই রাখা হয়েছে, বরং আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে অং সান সু চি প্রমাণ করেছেন যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি (সেনাবাহিনীর প্রতি) তার সহযোগিতার হাতই বাড়িয়ে রেখেছেন। তবে নির্বাচনকে যতই অবাধ ও নিরপেক্ষ বলা হোক না কেন, যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিধন অব্যাহত থাকবে ততদিন গণতন্ত্রের পথে যাত্রা দুর্বলতর হবে – এমন মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।