ইবনে আলতাফ

মরহুম এড. খালেকুজ্জামান এক বিষ্ময়কর প্রতিভার নাম। শুক্লা দ্বাদশীর কিরণের ন্যায় যেমন আর্বিভাব, তেমনি বিজলির ন্যায় অর্ন্তধান। তিনি ছিলেন একাধারে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠিানের পরামর্শক এবং সফল রাজনীতিক। ফুল শয্যার ন্যায় জীবনকে বিসর্জন দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন রাজনীতির মত বন্ধুর অনিশ্চিত পথ। বিখ্যাত পিতার পরিচিতিকে ছাড়িয়ে নিজ নিজ প্রতিভা গুণে তাঁর প্রত্যেক সহোদররা হয়েছেন একেকটা রত্ম। সেই দ্যুতিমান রত্ম ছড়িয়ে আছেন দেশ-দেশান্তরে। স্বামী সন্তানের বিরহ নিয়ে বেঁচে থাকা মা রিজিয়া আহমদ স্বীকৃতি পেলেন ’রত্মগর্ভা’। কক্সবাজার সদরের মাছুয়াখালীতে সেই রত্মগর্ভার নামে আলো ছড়াচ্ছে ’রত্মগর্ভা রিজিয়া আহমদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। অদূরে ঈদগাঁওতে পিতা মৌলবী ফরিদ আহমদের নামে ’ঈদগাঁও ফরিদ আহমদ কলেজ’।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এড খালেকুজ্জামান একটি অনুসরণীয় নাম। তিনি দেখিয়ে গেছেন সমালোচনা মানে কন্টকের হুল ফুটানো নয়। বরং একটি পুষ্পের পাশে আরেকটি পুষ্প ফুটানো। তাঁর বাগ্মীতায় যেমন ছিল পরাগ কোমল সুর, তেমনি ইস্পাত কঠিন বজ্রধ্বনি। নিজ রাজনৈতিক দল বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সরকার দলের গঠনমুলক সমালোচনার কারণে তৎকালীন স্পিকার তার বক্তৃতার নির্দিষ্ট সময়ের পরিধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাস্ততার নিরিখে উদাহারণ ও আনকোড়া উপমার প্রয়োগে সংসদে তার ভাষণ ছিল সত্যিই উপভোগ্য। বর্তমানে আমাদের সংসদে সরকার দলের পক্ষপাতমুলক অতী একপেশে বক্তৃতা আর বিরোধী পক্ষের বাস্তবতা বিবর্জিত নেতিবাচক বিরোধীতা মরহুম এড. খাকেুজ্জামানের আকাল মনে করিয়ে দেয়।
তিনি ব্যক্তিগতভাবে তেমন ধনী ছিলেন না। পেশী শক্তির জোর ও ছিল না তার। ঢাকা শহরের পরিেেবশে আভিজাত্যে বেড়ে উঠা একজন ব্যক্তি কিভাবে মফস্বলে এসে স্থায়ী ঠাঁই করে নিলেন তা রিতিমত গবেষণার বিষয়। তিনি ছিলেন বড়ই হৃদয় দখলবাজ, অনায়াসেই চালাতেন কারো হৃদয়ে আগ্রাসন। ফলে পিঁড়ি নিয়ে বসে পড়তেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের অন্দরে। অপরিমিত অর্থের ছড়াছড়ি আর পেশী শক্তির জোর ব্যতিত তা কিভাবে সম্ভব? হ্যাঁ, সে অসম্ভবের বেসুর বাশরীতে সম্ভবের সুর দিয়েই বাশরী বাজিয়েছেন তিনি। কেউ মানুষের কাছে যায় অর্থ বিত্তের দাপটে, আর কেউ পেশীশক্তির জোরে। সবকিছুই শেউলার মত ভেসে যায়। কিন্তু মরহুম এড খালেকুজ্জামান অর্থবিত্তের দাপট আর পেশী শক্তির জোরে মানুষের কাছে যাননি। মেধা ও প্রজ্ঞার গুণে হৃদয় দিয়ে হৃদয় দখল করে নিয়েছিলেন তিনি। তাইতো তিনি মানুষের হৃদয়ে পদ্মের ন্যায় শেকড় গেড়েছিলেন। এটি ছিল তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি। অবশ্য সব রাজনীতিক চাইলেই হৃদয়ের বণিক হতে পারেন না। তাইতো তিনি বারংবার প্রতিহিংসার অনলে পুড়েছেন কিন্তু ভষ্ম হয়ে যাননি। বরং পুড়ে পুড়ে সোনার ন্যায় হয়েছে খাঁিট। বিরোধী রাজনীতিক দ্বারা তিনি কখনো আক্রান্ত হননি, নিজ দলের দুর্বৃত্তদের দ্বারাই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। কতোবার প্রকাশ্যে গুলি করে তাঁর প্রাণ সংহার করতে চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মানুষের ভালবাসা ও দোয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বাঁিচয়ে রেখেছিলেন।
এতো ভীতি ও অস্্র প্রদর্শনের পরও তাঁকে দমানো যায়নি, এমনকি সাধারণ মানুষও একচুল পরিমাণ তাঁর কাছ থেকে সরে যায়নি। বরং দ্বিগুণ ভালবাসার পলাস্তারা দিয়ে আগলে রেখেছিলেন তাঁকে। আমাদের দেশে কোন অভিভাবক চায়না তার সন্তানরা রাজনীতিতে আসুক। আজ দেশের রাজনীতিতে মেধাবী রাজনীতিকের আকাল এ অনাগ্রহের অন্যতম কারণ। যার কারণে রাজনীতিতে মেধার পরিবর্তে চর্চা হচ্ছে অর্থবিত্ত ও পেশী শক্তির। তাই দেশের যে কোন রাজনৈতিক দলে মরহুম এড খালেকুজ্জামানের মত বাগ্মী, মেধাবী ও অহিংস রাজনীতিকের অতীব প্রয়োজন।
মরহুম এড খালেকুজ্জামান রাজনৈতিক ফায়দা হাসির করে ব্যবসার পসরা সাজান নি। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নামে বেনামে ভূমি দখল করেন নি। কোন অদৃশ্যমান পেশায় থেকে অগোচরে সম্পদের পাহাড়ও গড়েন নি। আমৃত্যু আইন পেশায় নিয়োজিত থেকে শিক্ষতা ও সফটঅয়ার নির্মাণ করে তিনি জীবন যাপন করতেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা, সততা, মেধা ও বাগ্মীতা দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আর্কষণ করতে পেরেছিলেন। আচমকা মেহেনতি মানুষের দ্বারে উপস্থিত হয়ে চমকে দিতেন তিনি। বলতে গেলে তাঁর বদান্যতায় (জাতীয় সংসদের) কক্সবাজার সদর-রামু আসন বিএনপির জন্য স্থায়ী অসনে পরিণত হয়। এড খালেকুজ্জামানের আগে এখানে কেউ বিএনপির জন্য আমজনতার মাঝে এতে ঢেউ তুলতে পারেন নি। তিনিই সদর রামু আসনে বিএনপির জন্য জনগকে জাগিয়ে তুলার অগ্রদূত। তিনি তা প্রমাণ করেছেন এ আসনে পর পর দু’বার এমপি নির্বাচিত হয়ে।
২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের মাত্র তিনদিন আগে রামুর (আজকের খালেকুজ্জামান চত্তরে) বিশাল জনসমূদ্রে অজ্ঞান হয়ে পড়লে আর তাঁর জ্ঞান ফিরেনি। হাসপাতালেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদে শোকে মোয্যমান হয়ে পড়ে রামু-কক্সবাজারবাসী। বর্তমান রামুর বাইপাস ’খালেকুজ্জামান চত্তর’ তাঁর সেই উজ্জল স্মৃতি বহন করছে। তাঁর অকৃত্রিম র্কীতিকে মুছেদিতে কৃত্রিম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বারবার।
কক্সবাজার সাগর পাড়ের জেলে পার্কে হয়েছিল মরহুম এড খালেকুজ্জামানের নামাজে জানাযা। এটি ছিল যেন স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ জনসভা। তবে এই জনসভায় বাগ্মী খালেকুজ্জামান বক্তৃতা দেননি। এতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, রাজনীতির ভেদাবেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো কক্সবাজারের সকল রাজনীতিক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ। সেদিনি বক্তৃতার ভাষা কন্ঠ ধারণ করেনি। ধারণ করেছিল নয়ন, নিরব রোদনে। একদিকে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি, আর ঝাউবিথীকার অগনন সারি। অন্যদিকে মরহুম খালেকুজ্জামানকে শেষ বিদায় জানাতে আসা বেশুমার জনতার ঢল। যেন কেউ কারে নাহি হারে সমানে সমান।
খালেকুজ্জামান মৃত্যুপরবর্তী শূন্য আসনে তাঁর সাজানো সিংহাসন দখলে নিতে নিজ দলের সুযোগ সন্ধানীরা অনেক ষড়যন্ত্র ও কারসাজির ব্যার্থ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জনতার ভালবাসার তীব্রবানে পলকেই তা ভেসে যায়। সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে খালেকুজ্জামানের উত্তরাধিকার হিসেবে অনুজ সহোদর ইঞ্জনিয়িার মোহাম্মদ সহিদুজ্জামানকেই বেছে নেয় জনগণ। তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে বলা কলাগাছ হয়ে যায় তাদের হৃদয়ের প্রতীক। দেশব্যাপী আলোচিত সেই কলাগাছ কাহিনী আর কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির ভাগ্যে জোটেনি আজো। অনুজ সহোদর ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ সহিদুজ্জামানও অগ্রজের র্কীতির স্বাক্ষর রেখেছিলেন সংসদেও মাঠে ময়দানে। রাজনীতিতে আগাগোড়া অনকোরা একজন ব্যক্তি আচমকা সংসদে দাঁিড়য়ে এমনভাবে বক্তব্য রাখলেন যেনো তিনি পূর্বের অভিজ্ঞ ঝানু কোন রাজনীতিক। সুচারু চয়নে, বিন্যস্ত বচনে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ সহিদুজ্জামানের বক্তব্য ছিল চিত্তাকর্ষক। সততার দৃষ্টান্ত স্বরুপ তিনি লাভ করেছিলেন ’স্বর্ণপদক’।
সেনাসর্মথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তন্ন তন্ন করে খোঁজেও তাঁর কোন কাজে কোন দুর্নীতি তো পায়ইনি বরং প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। উজ্জল পূর্বসুরীর যেন উজ্জল উত্তরাধিকার।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মরহুম এড খালেকুজ্জামানের ১৭ তম মৃত্যুবাষির্কী। যে রাজনৈতিক দলের জন্য তিনি জীবন বিপন্ন করেছিলেন সেই রাজনৈতিকি দলের কাছে তাঁর মৃত্যুদিন নিরবে আসে আর যায়। আহ! কতোই কৃতঘ্ন!
মরহুম এড খালেকুজ্জামানের মতো মহান হৃদয় চাষীর মৃত্যুদিনে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক ঃ কবি ও মরহুমের গুণগ্রাহী।