শাহীন মাহমুদ রাসেল

মাদক আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যা হিসেবে অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত। “জাতীয় সমস্যার” তালিকায় শীর্ষে উঠতে আর বেশিদিন দেরি নেই। আমার এই কথা অনেকের কাছেই উদ্ভট লাগতে পারে। তাই আমি আমার দেখা দুইটি ঘটনার বর্ণনা করব।

#ঘটনা ১-
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে অগোছালো জীবন কাটাচ্ছিল ফারুক (ছদ্মনাম)। বন্ধু হয়ে তাকে কাছে টানল মাদক। মাদক সেবনের কথা তার পরিবারের সবাই জেনে যাওয়াতে বাসা থেকে পকেট খরচ দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ। কিন্তু তাতে কি, মাদক তো আর বাদ দেওয়া যাবে না! মাদকের টাকা তার নিজেকেই যোগাড় করতে হবে। শুরু হয় তার সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকার থেকে গভীর রাতের ঘোর অন্ধকারের পানে এগিয়ে চলা। ছিনতাই, চুরি সহ নানা ধরণের অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পরে সে। কিছুদিন আগে চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে স; অতঃপর গণধোলাই– থানা পুলিশ। মর্মান্তিক ব্যাপার হল এই যে, তার বাবা মহল্লার মসজিদের ইমাম। তিনি লজ্জায়- ক্ষোভে ফারুককে ত্যাজ্যপুত্র করে দেন। এরপর বাহ্যিকভাবে হলেও কিছুটা শান্তি আসে তার পরিবারে।

#ঘটনা ২-
একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করেন ইদ্রিস (ছদ্মনাম)। তার এক ছেলে- এক মেয়ে। ছেলে অয়ন (ছদ্দনাম) ভাল রেজাল্ট নিয়ে স্নাতক পাশ করে কিছুদিন হয়। মেয়ে শ্রাবণী (ছদ্দনাম) উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধ্যয়নরত। বোঝাই যায়, সুখের সংসার। কিন্তু একটি ব্যাপার আছে এখানে; ইদ্রিস সাহেব মাদকাসক্ত। উনি প্রতি রাতেই মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরেন। মাঝ রাতে শুরু হয় তার স্ত্রী হেলেনাকে (ছদ্মনাম) অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ। স্ত্রী সহ্য করতে করতে এক সময় প্রতুত্যর করেন। নাটক গড়ায় মারামারি- কান্নাকাটিতে। নাটক শেষে রাতের বাকি অংশ কাটানোর জন্য প্রায়শই প্রতিবেশীদের ঘরে আশ্রয় নিতে হয় অসহায় গৃহিণীকে। তার উপর আবার মাদক কিনতে গিয়ে ইদ্রিস সাহেবের সম্পর্ক গড়ে উঠে অন্য এক নারীর সাথে। এতে তীব্রতর হতে থাকে হেলেনার উপর নির্যাতন- নিপীড়নের মাত্রা। আপনারা জেনে অবাক হতে পারেন, ৩৪ বছর আগে ইদ্রিস সাহেব ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন হেলেনাকে, এমনকি দুই পরিবারের মতামত ছাড়াই! তার ভালোবাসা আজ হেলেনার প্রতি নয়, মাদকের প্রতি- মাদকের ‘রাণী’র প্রতি।

আর ফলশ্রুতিতে আজ অয়ন বাধ্য হয়েই বাবা মাকে ছাড়া বিয়ে করে আলাদা বাসা নিয়ে থাকে, চাকুরি করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। শ্রাবণীও নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছে। ইদ্রিস সাহেবের স্ত্রী থাকেন তার বাবার বাড়িতে, কখনও আবার ছেলের বাড়িতে। আর ইদ্রিস সাহেব থাকেন তার নিজের ঘরে, একা। হয়তো ভাবছেন ইদ্রিস সাহেবের “নায়িকা” কোথায়? ওই মহিলাও এখন ইদ্রিস সাহেবের থেকে দূরে। কারণ মাদকের পয়সা জোগাতে গিয়ে উনার অনেক টাকা ঋণ হয় মহাজনী সুদে। ঋণের জ্বালায় চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে পেনশন- পি.এফ সব মিলিয়ে উনি ঋণ মিটিয়েছেন। এখন টাকাও নাই, পরিবারও নাই, “নায়িকাও” নাই। বিচ্ছিন্ন কয়েকটা দ্বীপ গজিয়েছে শুধু তার জীবন নদীর উপর!

প্রথম ঘটনায় পরিবারের এক কনিষ্ঠ সদস্য মাদকের জালে আটকা পড়ে। অশান্তি হয়েছে, কিন্তু পরিবার ভেঙ্গে যায় নি।

দ্বিতীয় ঘটনায় পরিবারটি ভেঙ্গে খান খান।

কারণ হল, প্রথমটিতে সদস্য মাদকাসক্ত; আর দ্বিতীয়টিতে কর্তা নিজেই আসক্ত।

আমাদের দেশের যুব সমাজ যে হারে মাদকের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তাতে করে ধরেই নেওয়া যায় যে, ক’দিন পর উপরে বর্ণিত ঘটনা ১’ এর চেয়ে ঘটনা ২’ এর অবতারণাই বেশি হবে আমাদের চারপাশ জুড়ে- আমাদের ঘরে। তখন কিন্তু সমাজ- সংসার- নৈতিকতা- মূল্যবোধ- বন্ধন সব হারিয়ে যাবে আমাদের মধ্য থেকে। তখন আর কিছুই করার থাকবে না। জনসমক্ষে হত্যা হবে, ধর্ষণ হবে, ছিনতাই হবে, চুরি হবে। আমরা ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি, “মিথ্যা সকল পাপের মা”। কিন্তু আজকাল বললে ভুল হবে না যে, “মাদক সকল অপরাধের মা”।

তাই আমাদের চারপাশের সব মানুষের কাছে আমার আকুল আবেদন, সবাই এগিয়ে আসুন- প্রতিরোধ গড়ুন, সচেতন হউন- সচেতন করুন। আর সরকারের কাছে আমার দাবী, থাইল্যান্ডের মত একটা অপারেশন চালান; দেখা মাত্র গুলি করা হউক মাদক ব্যাবসায়িদের। আমরা বাঁচতে চাই একটু ভালোবাসা নিয়ে, অটুট পারিবারিক- সামাজিক বন্ধন নিয়ে। আর, মানবাধিকার সংস্থা কি বলবে, সুশীল সমাজ কি বলবে, আপনাদের ভোট কমবে না বাড়বে এসব চিন্তা করা বাদ দিন। আজ যে শত- সহস্র পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে, অপরাধ বেড়ে চলছে- এসব নিয়ে তো মানবাধিকার সংস্থাগুলো কিছু বলে না! ওইসব কথায় কানে নিয়ে কোন লাভ নেই। “শুট অ্যাট সাইট” ঘোষণা করুন মাদক ব্যাবসায়িদের বিরুদ্ধে। বাঁচবে মানুষ- বাঁচবে স্বপ্ন।