শাহেদ মিজান, সিবিএন:
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে জন্য চরম ‘মাথা ব্যথা’র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপুল রোহিঙ্গা বাংলাদেশের অবস্থান করার পরও নতুন আরো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের প্রবেশের চেষ্টা করছে। মায়ানমারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দিকে ধেয়ে আসছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ঠেকাতে কঠোর হলেও তাতে স্বস্তি মিলছে না। দেশে অবস্থান করা বিপুল রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ ও নতুন করে ধেয়ে আসা রোহিঙ্গার ¯্রােত ঠেকাতে পুরো প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে কক্সবাজারে প্রশাসনের সামগ্রিক কর্মকা-ে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। একই সাথে কক্সবাজারের অর্থনৈতিকসহ পুরো সামাজিক পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাওয়ায় বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনসহ স্থানীয় লোকজরকে ভাবিয়ে তুলছে।
সূত্র মতে, আশির দশক থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। সেই থেকে মায়নামারে জাতিগত সহিংসতাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক দফায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হয়ে আসছে। সব মিলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গার সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে ২০১৬ সালের শেষের দিকে। ওই বছরের অক্টোবরে জাতিগত এক সহিংসতায় এক লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে বলে বিভিন্ন সংস্থার দাবি করেছিলেন। এর মধ্যে অনেকে ফিরে গেলেও অন্তত অর্ধেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে যায়। সর্বশেষ ফের জাতিগত সাহিংসতায় গত বৃহস্পতিবার থেকে বাংলাদেশে দিকে ধেয়ে আসছে রোহিঙ্গার ¯্রােত। বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর কঠোর পাহারা সত্ত্বেও এরই মধ্যে ১০ হাজারের কাছাকাছি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বিভিন্ন স্তরের সূত্র দাবি করছেন।
দাবি মতে, উখিয়ার বালুখালী, পালংখালী, উলুবনিয়া ও টেকনাফের হোয়াইক্যং, লম্ববিল, উনছিপ্রাং, ঝিমংখালী, খারাংখালী, হ্নীলার পুলের ডেইল, রঙ্গীখালী ও চৌধুরীপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। শুক্রবার বিকেলে নাফ নদী পাড়ি দেওয়া প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে বিজিবি ঠেকাতে পারলেও রাতের বেলা তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা টেকনাফের নয়াপাড়া, লেদা, উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পেগুলোতে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের সূত্র মতে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কক্সবাজারের পুরো প্রশাসনের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে জেলা প্রশাসন পর্যন্ত দৌড়ের উপর রয়েছে। একই সাথে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এই নিয়ে চরম ‘টেনশন’ বিরাজ করছে।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ধেয়ে আসা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বিজিবি কড়া পাহারা বসিয়েছে। এর জন্য বিজিবির বিপুল অতিরিক্ত সদস্য নিযুক্ত করা হয়েছে। তারা রাতে দিনে সমান কড়াভাবে সীমান্ত পাহারায় রেখেছে। এরমধ্যে বালুখালী, পালংখালী, উলুবনিয়া ও টেকনাফের হোয়াইক্যং, লম্ববিল, উনছিপ্রাং, ঝিমংখালী, খারাংখালী, হ্নীলার পুলের ডেইল, রঙ্গীখালী ও চৌধুরীপাড়া সীমান্ত পয়েন্টে বিশেষ পাহারায় রাখা হয়েছে। অন্যান্য পয়েন্টগুলোতেও বিশেষ পাহারা বসানো হয়েছে। বিজিবির সাথে কোস্টগার্ডের সদস্যরা জলসীমানা পাহারা দিচ্ছে। কোস্টগার্ডও দু’শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে ফিরিয়ে দিয়েছে। বিজিবি, কোস্টগার্ড ছাড়াও লোকালয়ে পুলিশী পাহারা বসানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে এখন পুরো প্রশাসন ব্যস্ত। জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, স্থানীয় পর্যায়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ওসি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দৌড়ের উপর রয়েছেন।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশ অনুসারে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন সার্বক্ষণিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। তিনি গত শনিবার উখিয়া উপজেলার প্রশাসনের সাথে জরুরী বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট সকলকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সর্বোচ্চ সতর্ক ও কঠোর থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও রাতের না ঘুমিয়েও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের রেখে চলেছেন জেলা প্রশাসক।
একই ভাবে বিজিবির কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার, কক্সবাজার বিজিবি, টেকনাফ বিজিবি ও নাইক্ষ্যংছড়ি বিজিবির অধিনায়কেরাও অত্যন্ত সজাগ রয়েছেন। তারা প্রতি মুহূর্ত সীমান্তের খবরা-খবর রাখছেন এবং সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে ‘টক অব দ্য ওয়ান’ হিসেবে দেখছে বিজিবির সদর দপ্তর। এর অংশ হিসেবে রোববার বিজিবির ডিজি আবুল হোসেন সীমান্ত পরিদর্শনে এসেছেন।
শুধু প্রশাসন নয়; নতুন করে রোহিঙ্গা ধেয়ে আসায় কক্সবাজারের মানুষও ‘টেনশন’ এ রয়েছেন। বিশেষ করে উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের মানুষ অত্যন্ত চাপের মধ্যে রয়েছেন। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে এসব উপজেলার বস্তি ও পাহাড় অধ্যুষিত এলাকায় বাংলাদেশীদের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যাহত হচ্ছে।
টেকনাফ রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক পারভেজ কায়সার চৌধুরীর অভিমত, রোহিঙ্গারা নিজেদের দোষে নিজেরা মরছে। যেখানে তাদের অস্থিত্ব রক্ষা দায় হয়ে পড়েছে সেখানে মায়মানারের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা করে বসে। গত বছরের অক্টোবরে সংঘটিত ও গত বৃহস্পতিবার সংঘটিত ঘটনাও একই রকম। হামলা করে নিজেরা মায়ানমারের বাহিনীর নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন। মূলত কিছু উগ্রবাদী রোহিঙ্গাদের কারণে পুরো রোহিঙ্গা জাতি কষ্ট পাচ্ছে। তাদের উচিত শান্তিপূর্ণভাবে তা সমাধানের চেষ্টা করা।
তিনি বলেন, ‘ যাই হোক রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে স্থান দেয়া সম্ভব হয়। কারণ আমাদের দেশও জনসংখ্যাবহুল একটি দেশ। এরই মধ্যে যেসব রোহিঙ্গা অবস্থান করছে তাদেরকে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। বার বার অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের মানুষের গলা কাটা দাঁড়িয়েছে। এই রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া-টেকনাফের মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না।’
তিনি বলেন, অনেক হয়েছে। আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নয়। তাদের আশ্রয় দিতে দিতে আমাদের পিট দেয়ালে ঠেকে গেছে। এবার রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধ করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে মায়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের সেদেশ নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ধেয়ে আসার বিষয়টিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বে সহকারে দেখছি। আমরা পুরো প্রশাসন এখন রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে কঠোরভাবে মোকাবেলার জন্য কাজ করছি। এই জন্য আমরা সময় দিয়ে বিশেষ নজর রেখেছি।’
বিজিবি মহাপরিচালক আবুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনও বিদেশি নাগরিককে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে যেকোনও ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত রয়েছে বিজিবি। ভবিষ্যতে সীমান্তের ক্যাম্পগুলোতে বিজিবির সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।’
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ৮৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৭৭ রোহিঙ্গা মুসলিম ও নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য রয়েছেন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর রোহিঙ্গা যোদ্ধারা পুলিশ পোস্টে হামলা এবং একটি সেনাঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলে এ সংঘর্ষ বাঁধে। এরপর শুক্রবার মায়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে গুলি করে হত্যা ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এর আগে ২০০১৬ সালের অক্টোবরেও মিয়ানমারের সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালিয়ে ৯ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা। এর ঘটনার জের মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা পল্লীতে গণহত্যা চালাচ্ছে।