প্রথম আলো:
এ মুহূর্তে বিএনপি তিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তা হলো দলের নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি। দলের নেতারা বলছেন, এরপর ডিসেম্বরের দিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পথনকশা চূড়ান্ত করা হবে।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি নিয়ে এ বছরের শেষ নাগাদ ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলনের চিন্তা করছেন। এর লক্ষ্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা। এ ছাড়া দলের নেতাদের অনেকের অনুমান, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা দুটির বিচারকাজ ডিসেম্বরের আগেই শেষ হতে পারে। এতে দলীয় প্রধানের সাজার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে চলতি বছরের শেষ নাগাদ একাদশ সংসদ নির্বাচনের দলীয় পথনকশা ঠিক করার লক্ষ্য স্থির করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।

আগামী মাসে ইসির সঙ্গে সংলাপে বিএনপি নির্বাচনী আইন সংশোধন এবং সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে মতামত দেবে। গত বৃহস্পতিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি ওঠে। যদিও আসন পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে দলের অবস্থান এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ইসির সঙ্গে সংলাপের পরপরই দলটি সামনে আনবে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রস্তাব।

আজ শনিবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সহায়ক সরকারের প্রস্তাব দেবেন। বৃহস্পতিবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সহায়ক সরকার নিয়েও আলোচনা হয়। সেখানে খালেদা জিয়া পুনর্ব্যক্ত করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন হলে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে এক কোটি নতুন সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। খালেদা জিয়া এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এবার ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিটি ওয়ার্ডে ২০০, পৌরসভার ওয়ার্ডে ৩০০ ও সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে ১ হাজার করে নতুন সদস্য সংগ্রহ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে কেবল জেলা, উপজেলা, পৌরসভার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সাবেক দলীয় সাংসদ এবং নির্বাহী কমিটির সদস্যদের ফরম দেওয়া হচ্ছে। এ কর্মসূচি সফল করতে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ৫৩ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে ৬৪ জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরবানির ঈদ পর্যন্ত নতুন সদস্য সংগ্রহ চলবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান বিএনপির একটি বড় কর্মসূচি। এর মাধ্যমে নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হবেন। সহায়ক সরকারের জন্য যে কর্মসূচি আসবে, তাতে নেতা-কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা এবং নির্বাচনের জন্যও প্রস্তুত করা হবে।

এর বাইরে মাঠপর্যায়ে দল পুনর্গঠন করছে বিএনপি। যদিও দলাদলি ও কোন্দলের কারণে গত দেড় বছরেও পুনর্গঠনের কাজ শেষ হয়নি। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪৯টিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যাওয়ায় কমিটি গঠনের কাজ স্থগিত থাকবে বলে জানা গেছে।

কমিটি পুনর্গঠন এবং সদস্য সংগ্রহ অভিযানের মধ্য দিয়ে সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটিও এগিয়ে রাখতে চাইছে বিএনপি। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরের মধ্যে দল পুনর্গঠন কার্যক্রম শেষ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দলের সব ইউনিট, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সকল পর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠন করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তো মনে হয়, বিএনপি সঠিকভাবেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি রাজনৈতিক দলকে এভাবেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত।’

বিএনপির তিন কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুটিকে স্বাগত জানান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি সহায়ক সরকারের চিন্তা নাকচ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সদস্য সংগ্রহ অভিযান একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। দলের স্বার্থেই এটা তাদের করা উচিত। ইসির সঙ্গে সংলাপের প্রস্তুতিকেও আমরা স্বাগত জানাই। আমরা চাই তারা আলোচনায় বসুক, ইসিকে শক্তিশালী করতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিক।’

বিএনপির নেতারা মনে করেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে আর ‘একতরফা’ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের প্রতি সামনে চাপ আরও বাড়বে। এ লক্ষ্যে বিএনপির একাধিক নেতা প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা কোনো একটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে খুব গুরুত্ব দিচ্ছি না। কারণ, আমরা কোনো দেশের নয়, জনগণের ওপর নির্ভর করি।’

দলীয় সূত্র জানায়, সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাবে ধরে নিয়েই নির্বাচনী কৌশল ঠিক করছেন বিএনপির নেতারা। এখন সরকারি দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছয় সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে পরিকল্পনা করছে, তাতে পরিস্থিতি যা-ই হোক বিএনপি অংশ নেবে। বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তখন বিদেশি কূটনীতিকদের অনেকে সেই নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বলেও জানা গেছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ঈদুল আজহার পরপরই খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি শুরুর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ধীরেসুস্থে এগোচ্ছেন। গতবারের কথা মাথায় রেখে এবার সব দিক ভেবে মাঠে নামতে চাইছেন খালেদা জিয়া।

দলের স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিন-তারিখ দিয়ে তো আন্দোলন হয় না। তবে সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়ার পর জনমত সৃষ্টির জন্য আমরা কর্মসূচি দেব। সেই কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। সহায়ক সরকারের ব্যাপারে সরকারের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে আন্দোলনের ফল।’

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য না করলে কোনো অসুবিধা নেই। তাদের বুঝতে হবে, এখন আর হরতাল-অবরোধের দিন নেই।

অবশ্য বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী মহল বলছে, দলটির এই আন্দোলনের মূল্য লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সমঝোতা। এ বিষয়ে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতটুকু জানি, বিএনপির আন্দোলন বিপ্লবাত্মক কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার স্বার্থে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করতে হচ্ছে। সে সময় তিনি বিরোধী দলকে নির্বাচনকালে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দেওয়ার কথা বলেছিলেন। বিএনপির আন্দোলন প্রধানমন্ত্রীকে ওই দুটি কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এবং সমঝোতার জন্য চাপ তৈরি করা।’