সিবিএন ডেস্ক
গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের ১৫৯ নম্বর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদের বাড়ির মালামাল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মওদুদ আহমদ নিজেই তার বাড়ির পুরো মালামাল বুঝে না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে তার শ্বশুর কবি জসীম উদ্দীন ও স্ত্রী হাসনা মওদুদের স্মৃতিবিজড়িত হাজার বছরের পুরনো বেশ কিছু মালামাল রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
‘খোদ রাজউকের কর্মকর্তারা এবং পাহারার দায়িত্বে থাকা পুলিশই এসব মালামাল হয়তো আত্মসাৎ করেছে, না হয় ভেঙে ফেলেছে’, বৃহস্পতিবার বাংলা ট্রিবিউনের কাছে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এমন অভিযোগ করেন। তবে তার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অঞ্চল ৩ ও ৪ -এর পরিচালক অলিউর রহমান।
মওদুদ অভিযোগ করেন, প্রথম দিনের উচ্ছেদের পর তার ভাড়া করা বাসায় যেসব মালামাল পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ৪৪ প্রকারের অন্তত ৪০০টি মালামাল তিনি বুঝে পাননি। যে মালগুলো তার জন্য অনেক মূল্যবান। বাড়িটি ভাঙার আগে এসব মালামাল ওই বাড়িতেই ছিল। দীর্ঘদিন চেষ্টা করে তিনি এগুলো সংগ্রহ করেছেন। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বিষয়টি বারবার জানানো হলেও তারা এসব মালামাল বুঝিয়ে দেননি। তারা কোনও কথাও শুনতে রাজি না।
মওদুদ আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাড়িতে থাকা অন্তত ৪৪ প্রকারের মালামাল আমরা পাইনি। এটাতো রাষ্ট্রের সম্পদ না। আমার মালামাল তো তারা নিয়ে যেতে পারে না। এটা আমার অধিকার লংঘন। ফৌজদারি অপরাধ। বাড়িটিও রাষ্ট্রের না। অস্ট্রিয়ান নাগরিক এর দাবিদার। তার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া হবে। মামলার রায়েও বাড়িটি যে রাজউকের তা বলা হয়নি। তারা কোন আদেশের বলে বাড়িটি ভাঙছে?’
তার অভিযোগ, তিনি যেসব মালামাল পাননি তার মধ্যে ১৬টি স্প্লিট এয়ার কন্ডিশনার্সের বাইরে থাকা কম্প্রেসার বক্স, ২টি শত বছরের পুরনোসহ ৪টি বড় ঝাড়বাতি, ৪টি ছোট ঝাড়বাতি, ৬টি সিলিং ফ্যান, জাকুজি বাথ, ১টি ফিটিংস অ্যান্ড ফিকচার্স, ১১টি কাঠের আলমারি, ৪টি বুক শেলফ, ১টি সুইমিংপুল ফিল্টার মেশিন, ৩টি পানির মটর, ৮০টি সেগুনকাঠের গ্লাস সংযুক্ত ফ্রেইম ও থাই অ্যালুমিনিয়ামের দরজা-জানালা, ২টি ডিশ এন্টেনা, ১টি স্টিলের আলমারি, ৫টি কাঠের চেয়ার, ৬টি স্টিলের চেয়ার, ২টি প্লাস্টিকের চেয়ার, ১টি প্লাস্টিকের টেবিল, বিভিন্ন ফুলের চারাসহ ২০০টি ফুলের টব,২টি ঘাস কাটার মেশিন, সার্চ লাইটসহ সমগ্র বাড়িতে ইলেকট্রিক ফিটিংস এবং ফিকচার সামগ্রী, ৭টি হাই কমোড সেট, বাথরুম ফিটিংস অ্যান্ড ফিকচার্স, সমগ্র বাড়ির মার্বেল ফিটিংস, ২টি আইপিএস সেট জেনারেটর, সিসি ক্যামেরা ৪টি, ২টি মনিটরসহ ১টি হার্ডডিস্ক সেট, বিপুল পরিমাণ দামি শাড়ি ও পোশাক, মূলবান বিরল পুস্তক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র। বিভিন্ন সরকার প্রধান এবং আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা মেমোরেবল ফটোগ্রাফ এবং তাদের দেওয়া বহু সুভেনিয়ার্স, বিভিন্ন নামকরা চিত্র শিল্পীদের দুর্লভ পেইন্টিংস ও নকশা রয়েছে।
এছাড়া এক হাজার বছরের পুরনো সংরক্ষিত মিশরের একটি পুরাকীর্তি বাটি, আদিকালের দরজা জানালাসহ নকশা করা একটি মূল্যবান কাঠের স্থাপত্য (আনুমানিক ১০/৬ ফুট), বড় লাইব্রেরি ঘরে শত শত বই রাখার জন্য বার্মাটিকের তৈরি দেয়ালে লাগানো ঘরব্যাপী ফ্রেইম করা শেলফ, ২টি গ্যারেজের লোহার কলাপসিবল গেট,বাড়িতে গমন ও নির্গমনের ৩টি বড় লোহার গেট, নিচ তলায় ১টি দুই বার্নারের গ্যাসের চুলা, ৪ বার্নারের ১টি গ্যাসের চুলা, প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় স্টিলের বেসিন এবং অন্যান্য কিচেন ফিটিংস, বাগানের ১০টি স্ট্যান্ড লাইট, বাগানে ১টি ঝর্ণা, সাদা রঙের ২টি অ্যান্টিক বেঞ্চ, ১টি দোলনা, ১টি স্লাইড, ১টি অরকিড রাখার বিশেষ ফ্রেইম, ৪টি এয়ার অ্যাডজাস্টেবল ফ্যান। তার ও স্ত্রী হাসনা মওদুদের প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ের হাতের লেখা পাণ্ডুলিপি রয়েছে। বাড়িতে আরও অনেক মালামাল রয়েছে, যেগুলো প্রাথমিকভাবে বলা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, বুলডোজার দিয়ে দায়িত্বহীনভাবে মালামাল সরানোর সময় ভাঙচুরের ফলে অনেক মালামাল দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দখলে নেওয়ার পর ২৫ জুন রাজউক বাড়ির ভেতরে থাকা ভবন ভেঙে দিয়েছে। সেসময় গণমাধ্যমের কোনও কর্মীকে ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অনেক দূর থেকে ছবি তোলার অনুমতি দেওয়া হলেও এর সামনে একটি বড় ট্রাক দাঁড় করিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এসময় দেখা গেছে, বাড়িটির ওপরে থাকা বেশ কয়েকটি এসির কম্প্রেসার বক্স, ফুলের টব বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
তবে বাড়িটি ভাঙার দায়িত্বে থাকা একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যেসব লোক বাড়িটি পাহারার দায়িত্বে ছিলেন, তারা রাতেই অনেকগুলো মালামাল নিয়ে গেছেন। আর যেগুলো রয়ে গেছে সেগুলোও ভবন ভাঙার সময় ভেঙে গেছে।
মওদুদ আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘৪৪টি আইটেমের কিছুই পাইনি। হয় লুট করেছে, না হয় ধ্বংস করেছে। এতে তাদের কোনও অধিকার নেই। সবই তো আইনের ঊর্ধ্বে। আইন বলতে এখন কিছু আছে নাকি? আমার এমন কিছু জিনিস ছিল যেগুলো অর্থ দিয়ে তুলনা করা যায় না। আব্বার (তার শ্বশুর কবি জসিম উদ্দিন) লেখা অনেক বই, আমার ওয়াইফের লেখা বই, অমর্ত্য সেনের বই ছিল। কিছুই পাচ্ছি না। এই বইগুলো কোথায় গেল? আজও খোঁজ করছি। এছাড়া ঐতিহাসিক অনেক নাম করা লেখকদের বই কলেকশনে ছিল। কিছু পেয়েছি, অনেকগুলো পাচ্ছি না। এগুলো আমার ‘সম্পদ’।’’
তিনি বলেন, ‘এই মালামালগুলোর বিষয়ে সেখানে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তালিকা পাঠিয়েছি। ফোনে কথা বলেছি। অন্তত আমার জিনিসগুলো দেন। একটাও দিলো না। তারা জানিয়েছেন, তারা নাকি কিছুই করতে পারবেন না। ওপরের তদারকি আছে। এখন জিনিসগুলো হয় নিয়ে গেছে, না হয় ধ্বংস করে দিয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ঞ্চল ৩ ও ৪ এর পরিচালক অলিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা পুরনো বিষয়। ওনার মালামাল সেই ১৪ জুনেই উনি বুঝে নিয়েছেন। সেখানে পুলিশ ছিল, ডিজিএফআইয়ের লোক ছিল। তার নতুন বাসার ঠিকানায় সব পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এর পর আমরা বাড়িটি দখলে নিই। বাড়ির পুরনো ভবন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেটা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’
গুলশানের ওই বাড়ির সার্বিক অবস্থাসহ মওদুদ আহমদের এসব মালামালের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে রাজউকের অঞ্চল-৪ এর অথরাইজড অফিসার আদিলুজ্জামান কোনও কথা বলতে রাজি হননি। এছাড়া রাজউক সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) মো. আসমাউল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বারবার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, এক বিঘা ১৩ কাঠা আয়তনের পরিত্যক্ত বাড়িটিতে ১৯৭২ সাল থেকে বসবাস করে আসছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এ অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর গুলশান থানায় মওদুদ ও তার ভাই মনজুর আহমদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। স্বাধীনতার আগে ওই বাড়ির মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। তার স্ত্রী অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর পর ‘ভুয়া’ আম-মোক্তারনামা তৈরি করে মওদুদের ভাই মনজুর আহমদের নামে বাড়িটির দখল নেওয়া হয় বলে অভিযোগ আনা হয়। দীর্ঘদিন মামলা চলার পর গত ৪ জুন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগ মওদুদের আপিল খারিজ করে দেন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।