মোরার তান্ডব :
শাহীনশাহ, টেকনাফ :
পাহাড়ের চূড়ায় বসবাস অংথাইন চাকমার(৩৫)। পেশা হিসেবে চল্লিশ থেকে ষাড শতক জমিতে চাষাবাদ ও ক্ষেত খামার। অন্যান্য সময় নানান কাজর্কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর সংসারে রয়েছেন বৃদ্ধা মা মাইন্যং চাকমা, স্ত্রী চানুছা চাকমাসহ ৪জন ছেলে মেয়ে। তাদের পড়ালেখা ছোঁয়া তেমন নেই। শুধুমাত্র অংথাইনের রুটি রোজগারে চলে তাঁর সংসার। ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ হলে তাঁদের কষ্টের অন্ত থাকেনা। অনাহার ও অর্ধাহারে থাকতে হয়। অতি সম্প্রতি অর্থাৎ ৩১ মে ঘুর্ণিঝড় মোরা’র তান্ডবে তার বাড়িটি চূর্ণবিচুর্ন হয়ে যায়। এই তান্ডবের এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। তখন যেমন এখনি তেমন রয়েছে তার ঘরবাড়ি ও আশে পাশের অবস্থা। অংথাইন বলেন, ৫০ হাজার টাকার চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যেখানে নুন আনতে পান্তা পুরায় সেখানে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সংস্কার বিশাল বিষয়। সীমাহীন বাতাসে ২ টি ছাগল ও একটি গরুর হদিস এখনো পাননি বলে জানান তিনি। এসব আহাজারী টেকনাফের আদিবাসী পল্লীর। অংথাইন টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের হুরিখোলা গ্রামের মৃত চেপু চাকমার ছেলে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় আদিবাসী পল্লীর করুন আর্তনাদের চিত্র। পাহাড় বেষ্টিত হুরিখোলার অংথাইনের বাড়িটি পাহাড়ের টিলায় হলেও জরাজীর্ণ অবস্থা খোলা আকাশের নিচে তাদের দিনাতিপাত ও নিত্যদিনের কার্যক্রম। তাদের পাশে থাকে ৩/৪টি গরুসহ হাঁস মুরগী। ছেলে মেয়ে বস্ত্রহীন হয়ে কাঁদামাখা রয়েছে যে কোন সময় নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
পাশের এলাকার মৃত অংথাইচা ছেলে কালাইয়া (২৭)। মোরা’র আঘাত হানার দুইদিন আগে ঘরটি তৈরী করেছিলেন। মোরার তান্ডবে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় তার নতুন বাড়িটি। তাঁর সংসারে ৩ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। তাঁর পেশা দিনমজুর। ত্রাণ বা সাহায্য সহযোগিতার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। একদল সংবাদকর্মী পল্লীতে পরিদর্শন করলে দৌঁড়ে আসেন তিনি। অশ্রুসিক্তবস্থায় অকপটে বর্ণনা করেন তাঁর অভাব অনটনের কথা। কেবল এই দুই পরিবারের বাস্তব কাহিনী নয়। টেকনাফের পাহাড়ী এলাকার সব আদিবাসী পল্লীর একই অবস্থা । শোকে, মূর্ছায় তাদের মাঝে নিরব আহাজারী চলছে। খোঁজ খবর ও অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, মোরায় সবচেয়ে বেশী ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও ফলজ, বনজ, ফার্ম চিংড়ি ঘেরসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে টেকনাফ উপজেলায়। এই উপজেলার টেকনাফ, বাহারছড়া, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কোন কোন গ্রামে আদিবাসীদের বসবাস। এরই মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পাহাড়ী ও পাহাড়ের পাদদেশ এলাকার ঘরবাড়ী। বিশেষ করে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বাঘোনা, আমতলী, হুরিখোলা, ওয়রাপাড়ার পাহাড়ী আদিবাসী লোকজন। তাদের মাঝে দীর্ঘ সপ্তাহ পার হলেও কোন ধরণের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়নি। তবে শুধুমাত্র ১০ কেজি চাউল ১৫ পরিবারকে বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের মেম্বার বাবুধন তৈঞ্চজ্ঞা। তাও হিন্দু, মুসলিম ও চাকমার মাঝে সুষম বন্টণ করা হয়। তিনি দ্রুত সাহায্য সহযোগিতার দাবী জানান। এই ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা কিলং চাকমা বলেন, আদিবাসী বলে আমাদের কি দেখার কেউ নেই। ঘূর্ণিঝড় মোরার হানায় আদিবাসী পল্লীটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও কোন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ত্রাণ সামগ্রী ও সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। দৈনিক মজুরী করে বাড়িঘর সংস্কার বা পুনরায় নির্মাণ সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি। জাতি সত্তা মুক্তি পরিষদের কক্সবাজার জেলা সভাপতি মনি স্বপন চাকমা বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পাহাড়ী এলাকার যে সমস্ত আদিবাসী বা উপজাতি রয়েছে, তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এক সপ্তাহ পার হলেও কোন ধরণের অদৃশ্য বা দৃশ্যমান কোন সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রাকিব আহমেদ জানান, হোয়াইক্যং ইউনিয়নে শুধুমাত্র ২ মেঃটন চাউল বরাদ্দ পায়। বিধ্বস্ত পরিবার হিসেবে তা খুব বেশী অপ্রতুল। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক জানান, ইতিমধ্যে অনেক বিধ্বস্ত পরিবারদ্বয়কে সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ ও নগদ টাকা বিতরণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে সকল বিধ্বস্ত পরিবার ত্রানসহ নানা সাহায্য সহযোগিতা পাবে।
এদিকে দূর্যোগ কবলিত এলকায় সেতু ও সড়ক মন্ত্রী এবং আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ওবাইদুল কাদের গত শুক্রবার সকালে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে ত্রাণ ও নগদ টাকা বিতরণ করেছেন। তিনি শাহপরীরদ্বীপে ২ শত পরিবারে ১ হাজার করে নগদ টাকা ও ২০ টন চাল বিতরণ করেন। এর পরে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া টেকনাফ সদরে বিধ্বস্থ বাড়িঘর পরিদর্শন করে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। এসময় বর্তমান সাংসদ আবদুর রহমান বদি ও সাবেক সংসদ ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও স্থানীয় এমপি আবদুর রহমান বদি কতিপয় ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে চাল ও নগদ অর্থ বিতরন করেছেন।
সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানান, মোরার আঘাতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্মুখীন সাবরাং ইউনিয়ন। শুক্রবার ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ত্রান বিতরন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারি ত্রান ও নগদ টাকা বিতরন করা হয়েছে। পাশাপাশি নিজস্ব তহবিল থেকে ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়। তিনি আরো জানান, সাবরাং ইউনিয়নে ৫ হাজার ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ বিধ্বস্থ হয়েছে। সুপারী গাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত ও পান বরজ উপড়ে গেছে। এতে কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।