পূর্বপশ্চিমবিডি:

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্ধারিত সময় অনুযায়ী এখনো প্রায় দেড় বছর বাকি। কিন্তু হিসাব-নিকাশ করতে শুরু হয়েছে এখন থেকেই। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় রাজনীতির প্রাসঙ্গিক আলোচনার সব বিষয়কে ছাপিয়ে প্রধান আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার গতি-প্রকৃতি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা রাজনীতির মাঠে-ময়দানে বেশ উত্তাপও ছড়াচ্ছে।

মামলা দুটির বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে এই দুই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। মামলায় খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানির তারিখ পিছিয়ে আগামী ৮ জুন ধার্য করেছেন আদালত। আত্মপক্ষ সমর্থনের পরই সাফাই সাক্ষি ও যুক্তিতর্ক। এরপরই রায়। পুরান ঢাকার বকশিবাজারস্থ কারা অধিদপ্তরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী ঢাকার পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ ড. মো. আকতারুজ্জামানের আদালতে বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন আছে।

এ মামলার নিষ্পত্তি হতে কত দিন লাগবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে বিএনপির আইনজীবীদের পাশাপাশি নেতা-কর্মীদের মধ্যেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। নিম্ন আদালতে সাজা হলে নির্বাচন করতে পারবেন কিনা, তা এখনো অস্পষ্ট। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন এমপি-মন্ত্রীর সাজার রায়ের পরও স্বপদে বহাল রয়েছেন। তবে খালেদা জিয়ার এ মামলা দুটি সর্বত্রই এখন আলোচিত ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, সরকার বেগম জিয়াকে জেল দিতে চায়। আমরাও যথাযথভাবে চেষ্টা করছি ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) নির্দোষ প্রমাণ করতে।

সংবিধানের ৬৬ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি (ক) কোন উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন; (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করিয়া থাকেন; (গ) তিনি কোন বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইনে এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নেই। দুই ধরনের মতই আছে। নির্বাচন করতে পারবে, আবার পারবেও না। দুই পক্ষেরই ব্যাখ্যা আছে। দুই পক্ষের মতামত শুনে আপিল বিভাগে এ প্রশ্নের ফয়সালা হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আপিল বিভাগ এ নিয়ে কিছু বলছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারব না। আইনে দুই ধরনের ব্যাখ্যাই হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রী-এমপির সাজা হওয়ার পরও তারা স্বপদে বহাল রয়েছেন। এ উদাহরণের সুযোগ বেগম জিয়া নিতে পারেন। বিএনপি মনে করতে পারে, সাজা হলেও এ বিধি তাদের পক্ষেই যাবে। সাজাপ্রাপ্ত মন্ত্রী-এমপিরা যেহেতু সপদে বহাল রয়েছেন, সেহেতু একটা ব্যাখ্যা দাঁড়াচ্ছে সাজা হলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না।’

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে নির্বাচন করতে পারবেন না, এটা ঠিক নয়। ধরা যাক মিথ্যা মামলায় একটি রায়ে তার (খালেদা জিয়া) সাজা হয়ে গেল। ভালো কথা, আমরা আপিল ফাইল করব। আপিলটা হলো কনটিনিউশন অব দা প্রসিডিংস। অর্থাৎ যে বিচার হয়েছে, এটা হলো সে বিচারের ধারাবাহিকতা। তখন আমরা তাঁর জন্য ইনশাআল্লাহ জামিন নেব। বেগম খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হলেও নির্বাচনে সরাসরি অংশ গ্রহণ করতে পারবেন।’ তিনি বলেন, সাজা হলেও খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি দল ও জোটের নেতৃত্বও দিতে পারবেন।

জানা যায়, নিম্ন আদালতে সাজা হলে আইনি লড়াইয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বেগম খালেদা জিয়া। এ নিয়ে আইনজীবী নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন বিএনপি প্রধান। রাজনৈতিকভাবে করণীয় নিয়েও ভাবছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। আন্দোলন কর্মসূচির কথাও ভাবা হচ্ছে। এরই মধ্যে দলটি ঘোষণা দিয়েছে, খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না। এ নিয়ে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকতেও বলা হয়েছে।

দলীয় সূত্রমতে, দুই মামলার ‘ইতিবাচক ও নেতিবাচক’ দুই দিক নিয়েই ভাবছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। নিকট অতীতে মামলার ইতিবাচক কোনো রায় বিএনপি পায়নি। এরই মধ্যে বেগম জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এক মামলায় ৭ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাকেও দেওয়া হয়েছে ১৩ বছরের সাজা। নিম্ন আদালতে সাজা হলে আপিল করা ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে কী করা হতে পারে তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সাজা হলে নিয়ম অনুযায়ী কারাগারে গিয়ে বেগম জিয়াকে জামিন চাইতে হবে।

আইনি প্রক্রিয়ায় বিএনপি প্রধানের সাজা হলে বিএনপি কী করবে এমন প্রশ্নে বিএনপির সিনিয়র এক আইনজীবী বলেন, ‘যদি এমন হয় তাহলে আমরা আইনগতভাবেই লড়ব। হাইকোর্টে আপিল করব। নেতিবাচক হলে কিছু দিনের জন্য বেগম জিয়াকে জেলে যেতে হতে পারে। তবে এসব মামলা জামিনযোগ্য। আদালতের মতের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে।’

খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ। আদালত বদল হয়েছে। আত্নপক্ষ সমর্থনের পর সাফাই সাক্ষী ও যুক্তিতর্ক রয়েছে, এরপর রায়। তবে সাফাই সাক্ষীর ওপর সময় বোঝা যাবে, কতদিন লাগবে।

বিএনপির সংশ্লিষ্টরা জানান, বেগম জিয়া কারাগারে গেলে দল পরিচালনা নিয়েও সংকট তৈরি হবে। ওয়ান-ইলেভেনের পর খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। এতদিনেও সেই ধকল কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপির নেতৃত্ব দেবেন কে— তা নিয়েও নানা ধরনের চিন্তাভাবনা হচ্ছে।