নীতিশ বড়ুয়া, রামু
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐতিহ্য রক্ষার আহ্বানে রামুর উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্বর্গপুরি উৎসব ও বুহ্যচক্রমেলা। শিশু ও নারী-পুরুষের মহাসম্মিলনে শুক্রবার (২১ এপ্রিল) ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এ উৎসবে অংশ নিয়েছে হাজারো বৌদ্ধ পুণ্যার্থী। বৌদ্ধরা ছাড়াও অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণ এ উৎসব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলনমেলায় পরিণত হয়। আড়াইশত বছরের পুরানো এ বৌদ্ধ বিহারে ৩২ বছর আগে তৎকালীন বিহার অধ্যক্ষ প্রজ্ঞামিত্র মহাথের রামুতে প্রথম ‘স্বর্গপুরী’ উৎসব’ প্রচলন করেন। ২০০৭ সালে প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র প্রয়ানের পর, তাঁর প্রধান শিষ্য সারমিত্র মহাথের বিহারের অধ্যক্ষের দায়িত্ব অর্জন করেন এবং গ্রামবাসির সহযোগিতায় স্বর্গপুরী উৎসব আয়োজন অব্যহত রাখেন।
স্বর্গপুরী অনুষ্ঠান রামুতে প্রথম এবং একমাত্র উৎসব। এ বছর ৩২তম এ উৎসবে কক্সবাজার জেলার রামু, উখিয়া, টেকনাফ, হ্নীলা, মহেশখালী, চৌফলদন্ডী, চকরিয়া, পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলীকদম ও খাগড়াছড়ি এবং চট্টগ্রামের পটিয়া, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বৌদ্ধ পুণার্থীরা অংশ নিয়েছে। রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রাচীন এ অঞ্চলের স্বর্গপুরী উৎসবে শত শত উপজাতি বৌদ্ধ পুণার্থীরা তাদের ঐতিহ্যময় কাপড় পরে অংশ নেয়, বৈচিত্রময় পোশাকে তাদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো ।
ধর্মসভা ও আলোচনা অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপ-সংঘরাজ, একুশে পদক ও মায়ানমার সরকারের আ¹ামহাস্বধম্মাজ্যোতিকাধ্বজ উপাধী প্রাপ্ত পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের। ভোরে প্রভাতফেরি সহকারে বুদ্ধপূজা, সকালে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, প্রয়াত প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র উদ্দেশ্যে স্মৃতিচারণ ও ধর্মসভা, অষ্ট পরিষ্টারসহ সংঘদান, ভিক্ষুসংঘের পিন্ডদানের মাধ্যমে দিবসের প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের অধ্যক্ষ সারমিত্র মহাথের’র স্বাগত বক্তৃতায় অনুষ্ঠিত ধর্মসভায় প্রধান ধর্মদেশনা দান করেন, বাঁশখালী শীলকুপ বৌদ্ধ বিহার অধ্যক্ষ আর্য্যপ্রিয় মহাথের।
জ্যোতিমিত্র ভিক্ষু’র পবিত্র ত্রিপিটক পাঠ ও কল্যাণ বড়ুয়া’র পঞ্চশীল প্রার্থনার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন, রামু থানা অফিসার ইনচার্জ প্রভাষ চন্দ্র ধর, জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল শামশুদ্দিন আহমদ চৌধুরী প্রিন্স প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ সহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ধর্মদেশনা করেন, পাঞাওয়ারা মহাথের, করুণাশ্রী থের, শীলমিত্র ভিক্ষু, সত্যপ্রিয় ভিক্ষু প্রমুখ। ধর্মালোচনা সভা সঞ্চালনা করেন, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু ।
দুপুরে অতিথি ভোজনের পর অনুষ্ঠিত হয় স্বর্গপূরী ও ব্যুহচক্র উদ্বোধন অনুষ্ঠান। বিকালে রামুর চার গ্রামের বৌদ্ধ কৃর্ত্যনীয়া দলের সং-নৃত্য পরিবেশন ও স্বর্গপুরী উৎসর্গ এবং সন্ধ্যায় প্রদীপ পুজা, আলোক প্রজ্জ্বলন, প্রয়াত বিহার অধ্যক্ষ প্রজ্ঞামিত্র মহাথেরের নির্বাণ সুখ ও বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ কৃর্ত্যনীয়া গ্রাম দলের সং-নৃত্যে অংশ নেয়, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার সংলগ্ন পশ্চিম মেরংলোয়া বড়–য়া পাড়া গ্রাম দল, মৈত্রী বিহার সংলগ্ন শ্রীকুল গ্রাম দল, রামকুট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন নাসিরকুল গ্রাম দল ও চাকমারকুল অজন্তা বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন চাকমারকুল গ্রাম দল।
রাতে বিহার প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত কবি গানের আসরে পান্ডিত্যজ্ঞানের পরিবেশন ঘটান কবিয়াল কুঞ্জমোহন বড়–য়া ও কাজল ভট্টচার্য্য। রামুর উত্তর মিঠাছড়ির এ উৎসব শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে বর্তমানে সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। এ উৎসবে শতাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষু, শ্রামণ অংশগ্রহণ করেন বলে জানান, বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া। বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারের আয়োজন সুষ্ঠু, সুন্দর ও যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনসহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি।
প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার অধ্যক্ষ সারমিত্র মহাথের জানান, প্রতিবছরের ন্যায় বাংলা নববর্ষের প্রথম শুক্রবার মহাসমারোহে স্বর্গপুরী উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। ভোরে গ্রাম প্রদক্ষিন করে বুদ্ধ পুজার মাধম্যে দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের শুভ সুচনা হয়। কারুশিল্পী প্রবীন বড়ুয়া তাঁর গ্রাম উত্তর মিঠাছড়ি’র তরুনদের নিয়ে প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও নির্মাণ করেছেন, উৎসবে মূলস্তম্ভ স্বর্গপুরী মন্দির।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক, আমাদের রামু ডট কম সম্পাদক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, স্বর্গপুরী উৎসব এটি কালে সংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধ অংশে পরিণত হয়েছে। মানুষ মূলত জীবদ্দশায় যে কর্ম করে, সে কর্ম অনুযায়ী বিভিন্ন কুলে তার জন্মান্তর ঘটতে পারে। স্বর্গপুরী উৎসবের মাধ্যমে এমন ধারণা দেওয়া হয়। সংসারে মানুষ জন্ম-মৃত্যুর গোলক ধাধাঁয় পড়ে ভবচক্রে ঘুরতে ঘুরতে কখনো স্বর্গও লাভ করতে পারে। কিন্তু সেখান থেকেও নির্দিষ্ট একটা সময়ের পরে তাকে চ্যুত হতে হয়। নিজ কর্মগুণে, কর্মদোষে মানুষ বিভিন্ন কুলে জন্ম গ্রহণ করছেন। এমন বৌদ্ধিক ধারণা থেকেই রামুতে স্বর্গপুরী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন বৌদ্ধপল্লী থেকে ভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে নেচে গেয়ে বৌদ্ধ কীর্তন সহকারে দল বেঁধে এ উৎসবে যোগ দিয়েছেন বৌদ্ধরা। স্থানীয় ভাষায় তাদেরকে বলা হয় ‘কান্ডবাজি’। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ এই উৎসব উপভোগ করেছেন।