মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, রাজস্ব শাখা ও উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত ১২ জন সার্ভেয়ারকে একত্রে বদলী করা হয়েছে। অপরদিকে, ১০ জন সার্ভেয়ারকে কক্সবাজারের উল্লেখিত কার্যালয় সমুহে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সোমবার ১৮ জুলাই চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী স্বাক্ষরিত পৃথক ৪ টি প্রজ্ঞাপনে মোট ২২ জন সার্ভেয়ারকে বদলী ও নিয়োগ দেওয়া হয়।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার আতিকুর রহমান (৪০) কে গত ১ জুলাই ২৩ লক্ষ ৬৩ হাজার ৯০০ টাকা নিয়ে আটক করার ১৭ দিন পর একত্রে ১২ জন সার্ভেয়ারকে কক্সবাজার থেকে বদলী এবং ১০ জন সার্ভেয়ারকে কক্সবাজারে নিয়োগ দেওয়া হলো।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এর ৩০১ নম্বর স্মারকে কক্সবাজার থেকে বদলী করা সার্ভেয়ারগণ হচ্ছেন-কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মোঃ সাইফুল ইসলামকে ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার সার্ভেয়ার দুলাল খানকে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মোঃ ইব্রাহিম ফয়সালকে বান্দরবান জেলার বান্দরবান সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মীর্জা মোঃ নুরে আলমকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার হজরত আলীকে নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মোঃ আবদুল কাইয়্যুমকে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার সার্ভেয়ার, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মোঃ শরীফুল ইসলামকে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার সার্ভেয়ার, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার জিয়াউর রহমানকে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মোহাম্মদ নুর উদ্দীন আলমকে খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার হিসাবে বদলী করা হয়েছে।

একইভাবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এর ৩০২ নম্বর স্মারকে কক্সবাজারের ৩ টি উপজেলা ভূমি অফিস থেকে বদলী করা সার্ভেয়ারগণ হচ্ছেন-কক্সবাজার সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর আলম, চকরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার সাখাওয়াত হোসেন এবং রামু উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মাহমুদুল হাসানকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় বদলী করা হয়েছে।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এর ৩০৩ নম্বর স্মারকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ৯ জন সার্ভেয়ারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কক্সবাজারে নিয়োগ দেওয়া সার্ভেয়ারগণ হলেন-চট্রগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সার্ভেয়ার মোঃ আবু সাঈদ, একই কার্যালয়ের সার্ভেয়ার মোঃ আবুল কাশেম, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মোঃ মনিরুজ্জামান, নোয়াখালী সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার প্রনতোষ সাহা, ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মোঃ সাইফুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার জামাল হোসেন, কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন, কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার সৈকত চাকমা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার রফিকুল ইসলাম।

এছাড়া, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এর ৩০৪ নম্বর স্মারকে লক্ষীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মোঃ সাজ্জাদ হোসেনকে পেকুয়া উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বদলী ও নিয়োগ দেওয়া সার্ভেয়ারগণকে আগামী ২৪ জুলাই এর মধ্যে বর্তমান কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত হতে প্রজ্ঞাপনে আদেশ দেওয়া হয়েছে। নতুবা পরদিন ২৫ জুলাই হতে তাৎক্ষণিকভাবে অবমুক্ত ( Stand released) বলে গণ্য হবে।

প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে কক্সবাজার বিমানবন্দরের তল্লাশি গেট থেকে প্রবেশের সময় কক্সবাজার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার আতিকুর রহমান এর কাছে টাকা পাওয়ার বিষয়টি মুঠোফোনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজকে জানান। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিক আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। কিন্তু ততক্ষণে সার্ভেয়ার আতিকুর ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ায় তাকে আটকাতে পারেনি কক্সবাজার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। পরে ঢাকা হজরত শাহজালাল (র:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে ঘুষের সাড়ে ২৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯০০ টাকাসহ আতিকুর রহমানকে আটক করা হয়। সেখানে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি টাকার উৎস সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঠিক উত্তর দিতে পারেননি।

পরে আতিকুর রহমানকে আরেকটি উড়োজাহাজে করে পুনরায় কক্সবাজারে ফেরত এনে জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আতিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখানেও তিনি টাকার উৎস সম্পর্কে সদুত্তর দিতে না পারায় ১ জুলাই রাতে তাকে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় হস্তান্তর করে জেলা প্রশাসন। পরের দিন ২ জুলাই আতিকুরকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালতের বিচারক আতিকুর রহমানকে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

পরে ৪ জুলাই তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালতে মামলা করে দুদক। দুদক কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে হস্তান্তর, স্থানান্তরের চেষ্টা করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২), ৪(৩) ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাটি দায়ের করেন। একই সময় সার্ভেয়ার আতিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আবেদন শুনানি শেষে আদালতের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

দুদক সমন্বিত কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে সার্ভেয়ার আতিকুর রহমানকে। সোমবার ১৮ জুলাই বেলা একটার দিকে আতিকুর রহমানকে জেলা কারাগার থেকে বের করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নেয় দুদক দল। এখন আতিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘুষের ২৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯০০ টাকার উৎস বের করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সার্ভেয়ার আতিকুরের বাড়ি সিরাজগঞ্জ পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর এলাকায়। তাঁর বাবার নাম আবদুর রহমান। তাঁর চাকরি বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে হলেও তিনি সংযুক্তিতে দেড় বছর ধরে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনের ভূমি হুকুম দখল (এলএ) শাখার অধীনে মহেশখালী উপজেলার দায়িত্বে ছিলেন। মহেশখালীতে সরকারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনসহ প্রায় ১৫টি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন আতিকুর রহমানসহ তিনজন সার্ভেয়ার।