মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১২ সাল। কক্সবাজার জেলার রামু, উখিয়া, টেকনাফের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত বেদনাময় ও আতংকের দু’টি রাত। পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগ এনে প্রথম রাতে রামু’র ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধদের অন্তত ৩০টি বসত বাড়ি, দ্বিতীয় রাতে উখিয়া, টেকনাফের ৭টি বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধদের কমপক্ষে ১১টি বসত বাড়ি নরপিশাচ দূর্বৃত্তরা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল।

এই জঘন্য হামলায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল শত বছরের অনেক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও বৌদ্ধ নিদর্শন। আস্থাহীনতায় পড়েছিলো এ অঞ্চলের হাজার বছরের লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। এই ঘৃণ্য ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে বিশ্বনেতৃবৃন্দ, সীমাহীন আস্থার সংকটে পড়ে সারাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়। আতংকিত হয়ে যায় তাঁরা। এই পৈচাশিক নারকীয় ধ্বংসজজ্ঞের পর প্রধানমন্ত্রীর তড়িৎ হস্তক্ষেপ, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দেশী বিদেশী এনজিও, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, স্থানীয় জনসাধারণ, গণমাধ্যম সহ বিভিন্ন মহলের অভুতপূর্ব সহযোগিতায় পুড়িয়ে দেয়া বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ পরিবারের বসতবাড়ি গুলো দ্রুততম সময়ে নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীতে পূণঃনির্মান ও পুড়িয়ে দেয়া বৌদ্ধ পরিবার সমুহকে পূর্ণবাসন করা হয়। এক সময়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শহর হিসাবে খ্যাত রামুতে এ পৈশাচিক ঘটনায় হৃত শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরে আসে। কিন্ত এ সব ঘটনায় দায়ের করা মামলা গুলোর একটিও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। মূলতঃ মামলাগুলো আদালতে বিচারের জন্য তৈরি হওয়া সত্বেও সেগুলোর কোন গতি ও কার্যক্রম নেই।

এ ঘটনায় ৩৭৮ জনকে এজাহারভূক্ত করে দায়েরকৃত ১৯টি মামলার মধ্যে বাদী কর্তৃক ১টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। অবশিষ্ট ১৮ টি মামলায় ৯৯৫ জন’কে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়। এই ঘৃন্য ও নিন্দনীয় ঘটনার দীর্ঘ ৯ বছর অতিবাহিত হলেও সাক্ষী দেওয়ার অভাবে মামলা গুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এখনো শাস্তি পায়নি এ ঘটনার প্রকৃত দোষীরা। মামলাগুলোর অগ্রগতি খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। বলতে গেলে কোন অগ্রগতি নেই। আদালতে শুধু দিন পড়ছে আর পড়ছে। ১৮ টি মামলায় এ পর্যন্ত মাত্র একজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে অসন্তোষ কিছুটা এখনও রয়ে গেছে।

মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার বিষয়ে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি এডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, ১৮টি মামলার সকল সাক্ষীদের আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারী করা হয়েছে। পিপি এডভোকেট ফরিদুল আলম আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়, মামলার আসামী ও সাক্ষীরা একই এলাকায় বসবাস করেন। পুড়িয়ে দেয়া বৌদ্ধ বিহার গুলো নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীতে পূণঃনির্মান ও বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া বৌদ্ধ পরিবার গুলোকে পূর্ণবাসন করায় তাদের সকলের মধ্যে ক্রমান্বয়ে সৌহার্দপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাই মামলার সাক্ষীরা ঘটনার বিষয়ে আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছে।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কক্সবাজার জেলা সভাপতি এডভোকেট দিপংকর বড়ুয়া পিন্টু এই ধ্বংসজজ্ঞ থেকে তড়িৎ উত্তরণে সহযোগিতা করায় প্রধানমন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। এডভোকেট দিপংকর বড়ুয়া পিন্টু বলেন, সকলের প্রশংসনীয় উদ্যোগে বৌদ্ধ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পূণঃ প্রতিষ্ঠা ও আতংক অনেকটা দূর হয়েছে। তিনি এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা গুলোর সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহন ও অন্যান্য আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে মামলাগুলো চুড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।