তোফায়েল আহমদ :  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার (২৯ আগস্ট) বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের উদ্বোধনী ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে নিজেই জাতির জনককে নিয়ে কক্সবাজারের অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, কক্সবাজারের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা আকর্ষণ ছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, কক্সবাজার সৈকতের ঝাউবিথীটিও হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর অবদান। ১৯৭৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জীবনের শেষ বার তিনি কক্সবাজার যখন এসেছিলেন তখনই কক্সবাজারের পর্যটনের সৌন্দর্য বৃদ্ধিসহ শহর রক্ষার জন্যই ঝাউগাছের বনায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

স্থানীয়রা আরো জানেন, বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার উপকূলের ভারুয়াখালীর লবণ মাঠ পরিদর্শন করেছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি ঘাট যেটা স্থানীয়দের কাছে মুজিব ঘাট নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু রামু রাবার বাগানের রেস্ট হাউজে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই রেস্ট হাউজে বঙ্গবন্ধুর বসার চেয়ারটি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। বাস্তবে কক্সবাজারে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক স্মৃতি বিজড়িত স্থানও। কিন্তু এ যাবৎ পর্যটন শহর কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য একটি ম্যুরাল বা স্মৃতিফলক স্থাপিত হয়নি।

ফি বছর জাতীয় দিবসগুলো বিশেষ করে ১৫ আগস্টের শোকাবহ দিন এবং ১৭ মার্চের জাতির জনকের জন্মদিন সামনে নিয়ে কক্সবাজারের সুশীল সমাজ মাতামাতি শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত পর্যটন শহরটিতে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি নিয়ে। কক্সবাজারের প্রতি জাতির জনকের এত বেশি দরদ ছিল কিন্তু কক্সবাজারবাসী এ যাবৎ একটি ভাস্কর্য বা ম্যুরাল স্থাপনের মাধ্যমে তার প্রতিদান দিতে না পারার জন্য অনেকেই ক্ষুব্ধ।

স্থানীয় লোকজনের দাবি কক্সবাজার শহরের প্রবেশদ্বার কলাতলি গোলচত্বর মোড়কে বঙ্গবন্ধু চত্বর ঘোষণা দিয়ে সেখানে ১০০ ফুট উঁচু একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হোক।
কক্সবাজারের সংস্কৃতিকর্মী দীপক শর্মা দীপু এ বিষয়ে বলেন, পর্যটন মৌসুমে তথা পহেলা বৈশাখ ও থার্টিফার্স্ট নাইটসহ বিশেষ দিবসে দৈনিক কয়েক লাখ পর্যটকও আসেন কক্সবাজারে।

তিনি জানান, সাগর পাড়ের কলাতলী মোড়ে যদি স্মৃতিফলকটি স্থাপন করা যায় তাহলে দেশ-বিদেশের ভ্রমণকারীদের মধ্যেও সাগরের মতো উদার মনের মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি দেখে ক্ষণিকের জন্য হলেও জাগ্রত হবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা।

অভিযোগ উঠেছে, যতবারই সাধারণ মানুষ শহরের প্রবেশদ্বারে একটি স্মৃতিফলকের জন্য সোচ্চার হয়েছেন সেই তুলনায় জাতির জনকের দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের তরফে তেমন সাড়া মিলেনি। তবে গত ১৫ আগস্ট কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের শোক দিবসের অনুষ্ঠানে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান নানাজনের দাবির মুখে ঘোষণা দিয়েছেন, পৌরসভার উদ্যোগে কক্সবাজার শহরের গেটওয়ে কলাতলিতে জাতির জনকের একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হবে। কিন্তু তাও বাস্তবায়ন আদৌ হবে কিনা সেটা বলা মুশকিল।

তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক কারণে অনেকবার কক্সবাজার এসেছেন বঙ্গবন্ধু। সেই সময় কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ তিনি করেছেন। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে সর্বশেষ ১৯৭৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি কক্সবাজার এসেছিলেন। এ সময়ের মধ্যে অন্তত ১৪ বার তিনি কক্সবাজারে আসেন। তবে নানা ইতিহাস ও পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজারে ১২ বার সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলেও আরো অন্তত ২ বার সফরের ইতিহাস রয়ে গেছে অজানা।

এমনকি ১৯৫৮ সালের আইউব খানের সামরিক শাসন কেন্দ্রিক অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলা মাথায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু কয়েকবার কক্সবাজার আসার কথা রয়েছে প্রবীণদের মুখে। এসবের কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। কেবলমাত্র ১৯৫৮ সালের ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের বন বিভাগের রেস্ট হাউজের সংরক্ষিত অতিথি নিবন্ধন খাতায় বঙ্গবন্ধুর সেখানে দুই দিন অবস্থানের তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে।

পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের বাসিন্দা আছত আলী, উখিয়ার ইনানীর ছৈয়দুর রহমান সিকদার ও অরণ্যঘেরা ইনানীর চেনছড়ি আদিবাসী পল্লীর প্রয়াত ফেলোরাম রোয়াজা চাকমাসহ কক্সবাজার বন বিভাগের প্রয়াত গাড়িচালক আবুল বাশারের সান্নিধ্যে। কিন্তু জাতির জনকের ইতিহাসের এসব অংশটি রয়ে গেছে পুরোপুরি অনুদঘাটিত। তবে উখিয়ায় বঙ্গবন্ধুসহ প্রধানমন্ত্রী এসেছেন বলে রবিবার কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তব্যে খানিকটা স্মৃতিচারণে উঠে আসে।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন- ‘কক্সবাজারের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা আকর্ষণ ছিল। প্রতি শীত মৌসুমে আমাদের নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যেতেন। উখিয়াতে জঙ্গলের পথ বেয়ে বেড়াতে যেতাম। বাঘ-হাতির ডাক শুনতাম। যদিও এখন সেই চিহ্ন নেই।’ প্রসঙ্গত ২০১০ সালের ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিন ও শিশু দিবসের দিন দৈনিক কালের কণ্ঠে-‘ইনানী অরণ্যে বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতবাস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

স্থানীয় প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা ও প্রয়াত ফেলোরাম রোয়াজা চাকমার পরিবারের সদস্য যারা সেই সময় বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা দিয়েছিলেন সেইসব ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু উখিয়ার ইনানীর অরণ্যঘেরা চেনছড়ি আদিবাসী পল্লীর দাপুটে নেতা প্রয়াত ফেলোরাম রোয়াজা চাকমার ঘরে গিয়েছিলেন। সেই সময় ওই অরণ্যে রীতিমতো বাঘ-ভাল্লুক আর হাতির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। সেই আদিবাসী নেতার ভিটায় অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু যে পুকুরটিতে গোসল আর অজু করেছিলেন সেটিও অক্ষত রয়েছে। কালের কণ্ঠের সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত আদিবাসী পল্লীতে একটি এফিটাপ স্মৃতিফলক নির্মাণ করছে।

  • কালেরকন্ঠ