অধ্যাপক আকতার চৌধুরী

২১ জুলাই পবিত্র ঈদুল আযহার রাতে কক্সবাজার সিটি কলেজের দুইজন ছাত্রকে একসাথে হারিয়ে সত্যি মনটা ভারাক্রান্ত। মেরিন ড্রাইভ সড়কে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।
এখানে কে দোষী, কে নির্দোষ? সেটাও বিচার করার অবকাশ নেই। এমন মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। তাদের মৃত্যুতে কক্সবাজারবাসী শোকাহত, স্তব্দ।

আমাদের সময় ১০০ সিসি’র মোটর সাইকেল ছিল স্ট্যান্ডার্ড। ১১০ সিসির মোটর সাইকেল চালাতেই ভয় পেতাম। এখনকার মোটর সাইকেলগুলো কত সিসির হয় আমার জানা নেই। তবে বুঝতে পারি, একটি কার মোটর সাইকেল চালকদের কাছে নস্যি। যখন দেখি আমার কারটাকে রাইট অথবা রং সাইড দিয়ে মোটর সাইকেল নিমেষেই হাইস্পিডে ক্রস করছে। ইদানিং রং সাইট থেকে সাইট নেয়াও তাদের কাছে একটা ফ্যাশন। তার উপর লাইনে না দাড়িয়ে আগে যাওয়ার জন্য  কি রাস্তা , কি ফুটপাত উজানি কৈ মাছের মত ছুটছে তারা।

আমাদের সময়ে হাত বাড়ালেই মোটর সাইকেল পাওয়া যেতনা। একটি বাই সাইকেল কেনাও কঠিন ছিল। এখন অর্থনীতির সাথে কেনার সামর্থও বেড়েছে। এ প্রজন্মের কাছে মোটর সাইকেল ‘তেজপাতা’। মোটর সাইকেল সব প্রজন্মের কাছে একটা ক্রেজ। কে কত জোরে চালাতে পারে, রেসিং বাইকের মত আঁকাবাঁকা করে চালাতে পারে এ নিয়ে তাদের মধ্যে আছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আছে অহংবোধ।   ভাবে, এতেই তাদের ইমেজ বাড়ে!

বয়সের এ সময়টা অনেক বিপজ্জনক। নিজেকে হিরো হিরো লাগে। মোটর সাইকেলে বসলেই তাদের মনে এক ধরণের অনুভূতি জাগে। তারা আর মোটর সাইকেলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না । মোটর সাইকেলই তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। আর তাতেই ঝরছে তরতাজা প্রাণ। ইয়াং জেনারেশনের এ অপমৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। আর কত মায়ের বুক খালি হবে!

এ প্রজন্মকে বলি, সাময়িক আনন্দ উচ্ছ্বাসের বশবর্তী হয়ে এতটা বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে বাবা-মা পরিবার পরিজনকে কাঁন্দাইওনা। কারণ তোমার পেছনে বাবা মার স্নেহ মায়া মমতা ভালবাসা ছাড়াও অনেক কষ্ট সাধ্য শ্রম আছে। অর্থ বিনিয়োগ আছে। সমাজ রাষ্ট্রের অবদান আছে। তার কিঞ্চিত শোধ করা তোমার দায়িত্বে পড়ে। তোমাকে মোটর সাইকেল কিনে দিয়ে তোমার অভিভাবক অপরাধ করেননি । কিন্তু তোমার অপব্যবহার তাঁকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছে। অকালে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারনা।

প্লিজ। সম্মানিত অভিভাবকগণ, আপনার সন্তানের প্রতি একটু নজর দিন। আজ সন্তান হারানোর বেদনায় যেভাবে হাসপাতালের বারান্দায় আহাজারি করছেন এটা আপনার প্রাপ্য ছিল। কারণ অভিভাবক হিসেবে আপনি ব্যর্থ।

হয়তো স্নেহের বশবর্তী হয়ে বলবেন, ‘ছেলেটাকে মানাতে পারিনি।’ এ কথায় আপনি পার পেয়ে যেতে পারেন না। পারিবারিক অনুশাসন দিয়ে আপনি তাকে মানাতে না পারলে আপনাকে শিক্ষকের সহায়তা নিতে হবে। শিক্ষক না পারলে সমাজের সহায়তা নিতে হবে। সমাজ না পারলে রাষ্ট্রের সহায়তা নিতে হবে। আপনার দায় দায়িত্ব এড়ানোর কোন সুযোগ নেই।

আমার অবাক লাগে, মাগরিবের একটু দেরী করে বাসায় ফিরলে কি জবাব দেব বাড়িতে? চিন্তা করতে করতে গলদঘর্ম হয়ে পড়তাম। আর এখন ছেলেরা রাত কোথায় কাটাল? তারও হিসাব নেন না অভিভাবকেরা!

তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ছাত্রদের উপর শিক্ষকের প্রভাব এখনো কিছুটা হলেও রয়েছে। ছাত্ররা শিক্ষকদের কথা শুনে, মানে। বিশ্বাসটা হারিয়েছে অভিভাবকরা। শিক্ষকদের উপর আবার আস্থা স্থাপন করতে হবে অভিভাবকদের। সন্তানের সমস্যাগুলো শেয়ার করতে হবে শিক্ষকের সাথে। আশা করি, আমাদের সন্তানেরা পারিবারিক অনুশাসনের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

কক্সবাজারে এরকম মোটর সাইকেল এক্সিডেন্টের ঘটনা অহরহ ঘটছে। আমরা আতংকিত থাকি আবার কোন আপনজনকে অকালে হারানোর দু:সংবাদটা কানে আসে। রিফাত ও আসিফ চৌধুরীরসহ সকল অকাল মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ ও আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আর কোন রিফাত আসিফকে যেন হারাতে না হয়, তার দায়িত্ব সকল অভিভাবকদের নেয়ার অনুরোধ করছি। আজ যা হারালাম, তা আর ফিরে পাবার নয়। তবে এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বৈকি?

-অধ্যাপক আকতার চৌধুরী
সহযোগী অধ্যাপক, কক্সবাজার সিটি কলেজ
সম্পাদক, কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন)।