ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা, আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে আজ। এই দিনে স্বাভাবিক নিয়মেই দেশের জনগণ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীন বাংলাদেশে ৭ নভেম্বরে সিপাহি জনতার বিপ্লবে ভূমিকা এবং স্বাধীন-সার্বভৌম আত্মনির্ভরশীল, আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সুদূরপ্রসারী ও যুগান্তকারী অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। আলোচনা হবে একজন ব্যক্তির জীবনে তিনটি সফল জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। শহীদ জিয়ার মধ্যে সৈনিক, রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনৈতিক জীবনের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য ও গুণের সমাহার ঘটেছিল। শহীদ জিয়া সৈনিক হিসেবে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ঘোষণা, সেক্টর ও ফোর্সেস কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধের মাঠে সশস্ত্র যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জন—তাঁর সৈনিক জীবন সফল বলে গণ্য। শহীদ জিয়া জাতির দুটি ক্রান্তিকাল যথা ২৫শে মার্চের কালরাতের হত্যাযজ্ঞ এবং ৩ থেকে ৭ নভেম্বরে সংঘটিত সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে জাতি যখন চরম হতাশায় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে নিপতিত, তখন জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। ৭ নভেম্বরে সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে শহীদ জিয়া দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দেশের সংবিধানে প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়গুলোর গ্রহণযোগ্য সমাধান, তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচিয়ে আত্মনির্ভরশীল, আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে একজন বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সফল জীবনের স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। শহীদ জিয়ার শাহাদাতবরণের পর ঢাকায় তাঁর নজিরবিহীন বিশাল জানাজা আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার বাস্তব প্রমাণ বহন করে। শহীদ জিয়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ গঠন এবং তাঁর দর্শন ও আদর্শ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য অবদান। সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তাঁর দর্শন ও আদর্শ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্তপ্রতীক। যার ফলে বিএনপি বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী, গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার রক্ষায় আপসহীন, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং আত্মনির্ভরশীল সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ জনগণের দল ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’। এই দল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শহীদ জিয়া একজন বিচক্ষণ ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।

বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে শহীদ জিয়ার মতো এমন একজন অনন্য ব্যক্তিত্বকে দেশের বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাঁর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করছে। শহীদ জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি পাকিস্তানি চর ছিলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করেছেন ইত্যাদি বলে তাঁকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা আওয়ামী লীগ অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি সরকার শহীদ জিয়ার ‘বীর-উত্তম’ রাষ্ট্রীয় খেতাব কেড়ে নেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র করছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ সরিয়ে শহীদ জিয়ার নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে শহীদ জিয়ার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে সংঘটিত গণহত্যার পর দেশের জনগণ স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিল, সে সময়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে। রাজনৈতিক দল থেকে সে সময় কোনো দিকনির্দেশনা না পেয়ে জনগণ যখন দিশাহারা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়, সেই মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তৎকালীন মেজর জিয়ার ‘বিদ্রোহ ঘোষণা’ এবং ২৬ ও ২৭ তারিখে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ সে সময়ে দেশের ও বিদেশের সবাই শুনেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস সঞ্চার করেছিল। এ বিষয়ে বহু বইপত্র, ডকুমেন্ট ও রাষ্ট্রনায়কদের বক্তব্যে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। তৎকালীন মেজর জিয়ার নেতৃত্বে সর্বপ্রথম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সেক্টর কমান্ডার এবং তাঁর নামের আদ্যক্ষরের নামে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ‘জেড ফোর্স’-এর কমান্ডার ছিলেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই শহীদ জিয়াকে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীর-উত্তম’ প্রদান করা হয়েছিল। গত এক যুগ যাবৎ শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্যে শহীদ জিয়া, তাঁর পরিবার ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল ‘বিএনপি’ সম্পর্কে ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার নানা অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

শহীদ জিয়া তৎকালীন মেজর জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ করে ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ দিয়েছেন এবং সর্বপ্রথম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সেক্টর ও ফোর্সেস কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় বীরত্ব ও সাহসী ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতিকে আবার দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সিপাহি জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দেশে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জাতিসত্তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ও সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন, ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির’ নামে লুটপাটের অর্থনীতির পরিবর্তে সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থনীতি প্রবর্তন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির দ্বার উন্মোচন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ পরিবর্তে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও সব ধর্মের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বহু মৌলিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। শহীদ জিয়া বাংলাদেশে পররাষ্ট্রনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। তাঁর সময়ে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। তিনি মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে ‘সার্ক’ গঠন করেছিলেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের স্বাধীনতা অর্জনে এবং মহান ভাষা আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারীদের সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ১৯৭৭ সালে ‘একুশে পদক’ এবং ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির মেরুদণ্ডের ভিত্তি মুক্তবাজার অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্টশিল্প এবং জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে রেমিট্যান্স অর্জন শহীদ জিয়ার অনন্য অবদান।

প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাতবরণের পর অনেকেই বলেছিলেন, জিয়া ছাড়া বিএনপি শূন্যে পরিণত হবে। ২০০৭ সালে জরুরি আইনের সরকারের সময়ও ‘বিরাজনৈতিকীকরণ’ এবং মাইনাস টু-এর নামে ‘মাইনাস খালেদা জিয়া’ করার ঘোষিত পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়েছে। সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে গ্রিক উপাখ্যানের সেই ‘ফিনিক্স পাখির’ মতো বিএনপির জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে। শহীদ জিয়াবিহীন বিএনপিকে সরকার এতই ভয় পায় যে বিগত নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন ও দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে কারাগারে আবদ্ধ রেখে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সরকার বিএনপির অগণিত নেতাকর্মীকে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং প্রায় ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এক লাখের বেশি মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দিয়ে বিএনপিকে দুর্বল করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতার ৫০ বছরের প্রকৃত ইতিহাস দেশের ঐতিহাসিকরা লিপিবদ্ধ করবেন। জনগণ, বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম দেশের প্রকৃত ইতিহাস ও সত্য জানতে পারবে। সত্য ও ন্যায় সব সময়ই পরিশেষে জয়লাভ করে এবং টিকে থাকে। মিথ্যা ও অন্যায় জনগণের ঘৃণা ও প্রতিরোধের সামনে খড়কুটার মতো ভেসে যায়। বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাস তারই সাক্ষ্য দেয়। বাংলাদেশেও ইতিহাসের সেই কঠিন সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। ন্যায় ও সত্যের জয় হবে।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী, সিনিয়র সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ভূতত্ত্ব বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়