মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মধ্যে ২৭ মে পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ১৪৫ জন। একইসময়ে আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছে ১৭ জন রোহিঙ্গা শরনার্থী।

কক্সবাজারস্থ শরনার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু মোহাম্মদ এইচ তোহা ভূইয়া এ তথ্য জানিয়েছেন।

একইসময়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় নাগরিক মারা গেছে ৯৫ জন। অর্থাৎ ১৭ জন রোহিঙ্গা শরনার্থী সহ গত ১৪ মাসে করোনা আক্রান্ত হয়ে কক্সবাজার জেলায় মৃত্যুবরণ করেছে মোট ১১২ জন।

ডা. আবু মোহাম্মদ এইচ. তোহা ভূইয়া আরো জানান, ২৭ মে পর্যন্ত কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে মোট ৪৩ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গা শরনার্থীর নমুনা টেস্ট করে এ ১ হাজার ১৪৫ জনের রিপোর্ট পজেটিভ আসে। তারমধ্যে, উখিয়ার ক্যাম্প গুলোতে ৯৫২ জন এবং টেকনাফের ক্যাম্প গুলোতে ১৯৩ জন রোহিঙ্গা শরনার্থীর দেহে করোনা শনাক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ৭৩৯ জন সুস্থ হয়েছেন। ২৭ মে পর্যন্ত অসুস্থ আছে ৪০২ জন। তারমধ্যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহের অভ্যন্তরে থাকা আইসোলেসন সেন্টার গুলোতে ২৩৮ জন করোনা আক্রান্ত রোহিঙ্গা শরনার্থী আইসোলেসনে রয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে আরো ৪ জন করোনা আক্রান্ত রোহিঙ্গা শরনার্থী। গত ১৮ মে থেকে গত ২৭ মে পর্যন্ত ১০ দিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে গড়ে ৩৫ জন করে করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে করোনা সংক্রামণ দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। আক্রান্ত ১ হাজার ১৪৫ জন রোহিঙ্গা শরনার্থীর মধ্যে গত শুরু থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ শতের নীচে। মার্চ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৮ শতেরও বেশি।

আরআরআরসি অফিসের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু মোহাম্মদ এইচ তোহা ভূইয়া আরো জানান, রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ১৩ টি SARI আইসোলেসন সেন্টারে ৯৬৪ টি বেড রয়েছে। আরো ৩ টি SARI আইসোলেসন সেন্টার চালুর অপেক্ষায় আছে রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে। কোভিভ-১৯ প্রকোপের শুরু থেকেই রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্প গুলোতে সংক্রামন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জরুরীভিত্তিতে করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধক প্রোগ্রাম সমুহ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মাঝে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জারীকৃত স্বাস্থ্যবিধি, বিধিনিষেধ মানানোর ব্যাপারে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে।

কক্সবাজারের শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াত জানিয়েছেন-কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে থাকা ৩৪ রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের মধ্যে ৫ টিতে করোনা সংক্রামণ আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় গত ২০ মে থেকে ৫ টিতে কঠোর লকডাউন (Lockdown) চলছে। এই লকডাউন আগামী ৩১ মে পর্যন্ত চলবে। লকডাউন কার্যকরে সরকারের করোনা সংক্রান্ত নির্দেশনা মতে কাজ চলছে। এছাড়া, অবশিষ্ট ২৯ টি রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে অত্যাবশ্যকীয় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সব নিয়মিত কার্যক্রম গত ২০ মে থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে করোনা সংক্রামণ বেড়ে যাওয়ায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা, খাদ্য সরবরাহ, আইনশৃংখলা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা ছাড়া ক্যাম্প গুলোতে আর সব নিয়মিত কার্যক্রম এখন মূলত বন্ধ। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে আগে গৃহীত কার্যক্রম সমুহও আরো জোরদার করা হয়েছে। এবিষয়ে তদারকিও বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

যে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো লকডাউন করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে -কুতুপালং ওয়েস্ট ২, ৩, ৪, ১৫ ও ২৪ নম্বর। এ ক্যাম্প গুলোতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম শরনার্থী শিবির বলে খ্যাত উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ টি রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের প্রত্যেকটিতে করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তবে লকডাউন করা উল্লেখিত ৫ টি ক্যাম্পে অপেক্ষাকৃত বেশী করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।
গত ২০ মে থেকে ক্যাম্প গুলোতে লকডাউন চলাকালে ক্যাম্প সমুহে জরুরী বিষয় ছাড়া সবকিছুর যাতায়াত বন্ধ থাকবে। এসময় ক্যাম্প থেকে কোন শরনার্থী বা স্থানীয় মানুষ বাহির থেকে এসে ক্যাম্পে প্রবেশ করতে পারবেনা। আবার ক্যাম্প থেকে কোন স্থানীয় মানুষ বা শরনার্থী লকডাউন চলাকালে বাইরে যেতে পারবেনা। লকডাউন চলাকালে জরুরী ও অত্যাবশ্যকীয় কর্ম, খাদ্য, চিকিৎসা ব্যতীত এনজিও, আইএনজিও, জাতিসংঘের সংস্থা সহ ক্যাম্প সমুহে কর্মরত সংশ্লিষ্ট সকলের গাড়ি চলাচল ও আসা যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।

এদিকে, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির এর কাছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের করোনা ভ্যাকসিনের আওতায় আনা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মধ্যে ৪০ বছর বয়স উর্ধ্ব রোহিঙ্গা সাড়ে ৩ লাখের বেশি হবেনা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত সরকারি, জাতিসংঘের সংস্থা, আইএনজিও, এনজিও, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য ইত্যাদি মিলেয়ে ৫০ হাজারেরও কম। করোনা সংক্রামণ নিয়ন্ত্রণে গবেষণারত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির বলেন, প্রায় মোট ৪ লক্ষ রোহিঙ্গা ও অন্যান্যদের প্রতিজনের জন্য ২ ডোজ করে সর্বোচ্চ ৮ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন আমদানি করলেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অতি সহজে করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধ করা যাবে। কোন কোম্পানির ভ্যাকসিনটি রোহিঙ্গাদের জন্য বেশি কার্যকর হবে বলে মনে করেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি, সিনেফার্মা ও ফাইজারের বায়োএনটেক নামক ৪ টি ভ্যাকসিন অনুমোদন দিয়েছে। তার যেকোন একটি আমদানি করলেই চলে। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation-WHO) এর সহায়তায় এ গুলো সহজেই রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জন্য আমদানি করা যায়।

এদিকে, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation) বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করছে। কক্সবাজার আরআরআরসি অফিস এ বিষয়ে
প্রাথমিক সকল প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে বলে জানিয়েছেন-কক্সবাজারের শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) অতিরিক্ত সচিব শাহ রেজওয়ান হায়াত।