বাংলা ট্রিবিউন: হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি গঠনের আগে ‘উম্মুল মাদারিস’ হিসেবে পরিচিত দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালনা ও প্রতিষ্ঠানটিতে পুরনো প্রভাব ফেরানোর বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন আল্লামা আহমদ শফীর অনুসারী আলেমরা। হেফাজতের নতুন কমিটি গঠনের আগে সারা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কওমি মাদ্রাসায় আহমদ শফীর সন্তান মাওলানা আনাস মাদানীকে পুনর্বহাল এবং নতুন পরিচালক নির্বাচনের দিকে মনোযোগ তাদের। আল্লামা আহমদ শফীপন্থী প্রভাবশালী আলেম ও  হেফাজতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে।

শফীপন্থী প্রভাবশালী ও হেফাজতের তিন জন উদ্যোক্তা-আলেম বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতের কমিটির বাইরে নতুন কমিটি করতে সরকারের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছেন আল্লামা শফীপন্থী আলেমরা। এই অংশের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাওলানা আনাস মাদানী রমজানের শেষ সপ্তাহে দুবাই থেকে ফিরে আসার পর আরও আলেমসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও সরকারের পদস্থ একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসব সাক্ষাতে সরকারের পক্ষ থেকে হেফাজতের নতুন কমিটি করতে সম্মতি মিলেছে।

এ বিষয়ে শুক্রবার (২১ মে) বিকালে মাওলানা আনাস মাদানী জানান, তিনি এখনই কোনও মন্তব্য করতে আগ্রহী নন। আর মুফতি ফয়জুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, তাদের উদ্যোগ চলমান রয়েছে। সময় হলেই তা সামনে আসবে।

 আল্লামা আহমদ শফী ও বাবুনগরীআল্লামা শফীপন্থীদের নজরে হাটহাজারী মাদ্রাসা

আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় হেফাজতের আহ্বায়ক জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জন আলেমের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গত ১২ এপ্রিল চট্টগ্রাম আদালতে এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

শফীপন্থী আলেমরা বলছেন, আল্লামা শফীর মৃত্যুর ঘটনায় বাবুনগরীর নাম আসায় হাটহাজারী মাদ্রাসায় তার অবস্থানের পরিবর্তন আসবে। আর এই পরিবর্তনের জন্য শফীপন্থী আলেমদের সঙ্গে সরকারের মতের মিল রয়েছে। সেক্ষেত্রে আগামী জুনে মাদ্রাসা পরিচালনায় পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।

আল্লামা আহমদ শফীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত বছরের জুলাইয়ে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পরিবর্তন আসে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—সহকারী শিক্ষা সচিবের পদ থেকে আনাস মাদানীকে অপসারণ, আল্লামা আহমদ শফী অক্ষম হওয়ায় মহাপরিচালকের পদ থেকে সম্মানজনকভাবে অব্যাহতি দিয়ে উপদেষ্টা বানানো। ছাত্র বিক্ষোভের চাপে পড়ে ওই সময় মাওলানা শেখ আহমদ, মুফতি আব্দুস ছালাম ও মাওলানা ইয়াহিয়াকে আগামী ছয় মাসের জন্য মাদ্রাসা পরিচালনায় অন্তর্বর্তীকালীন নিয়োগ দেয় শুরা কমিটি। আর মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শফীপন্থী প্রভাবশালী একজন আলেম বলেন, আইনগত কারণেই বাবুনগরী হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। এখন তিন জনের নেতৃত্বে মাদ্রাসা পরিচালনা করা হলেও পরিচালক হিসেবে দুজনের নাম আলোচনায় আছে। একজন আবদুস সালাম চাটগামী, যিনি পাকিস্তানের করাচিতে পড়াশোনা করেছেন এবং সেই দেশের একটি মাদ্রাসায় চাকরিও করেছেন। আরেকজন দিদার আহমেদ কাসেমী, যিনি ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করেছেন। এই দুজনের মধ্যে একজনকে কেন্দ্রে রেখে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে।

উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত একজন আলেম বলেন, হাটহাজারী মাদ্রাসার নেতৃত্বে পরিবর্তন না এলে আনাস মাদানী সেখানে যেতে পারবেন না। আর হেফাজত মানেই হাটহাজারী মাদ্রাসা, সেক্ষেত্রে আগে হাটহাজারী মাদ্রাসার বিষয়টি ঠিক হলেই নতুন হেফাজতের বিষয়টি সামনে আসবে। হেফাজতের যে নেতৃত্ব শূন্যতা, তাও কেটে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে আনাস মাদানীকে হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে তাকে বাদ দেওয়া হয়।

 শফীর ছেলে আনাস মাদানীবাবুনগরীদের সঙ্গে মিলবে না শফীপন্থীরা

আহমদ শফীপন্থী একজন গুরুত্বপূর্ণ আলেম শুক্রবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, আল্লামা আহমদ শফী সাহেবের মৃত্যুর ঘটনায় যাদের নাম এসেছে, তাদের সঙ্গে মিলেমিশে হেফাজতের কমিটি করার কোনও প্রশ্নই আসে না। যাদের হাত আহমদ শফীর রক্তে রঞ্জিত, তাদের সঙ্গে মিল-মিশের কোনও সুযোগ নাই। আমরা হুজুরের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইবো।

শফীপন্থী হেফাজতের উদ্যোক্তারা বলছেন, চলতি মে মাসে তারা সারা দেশের কয়েকটি জেলা সফর করবেন। এসব সফরে আহমদ শফীর অনুরাগী আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করবেন। এক্ষেত্রে আগামী ১৫ জুন অবধি সময় নিতে চান তারা।

শফীপন্থী প্রভাবশালী নেতা মুফতি মঈনুদ্দিন রুহী শুক্রবার দুপুরে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি সপ্তাহে আমরা ঢাকা সফর করবো। এরপর আরও কিছু সফর আছে। সেগুলো শেষ করে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবো। আগামী ১৫ জুনের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারবো বলে মনে করি।’

কেমন কমিটি হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে মঈনুদ্দিন রুহী বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফী ইন্তেকালের আগে যে কমিটি করেছিলেন, ওই কমিটিই আমরা নবায়ন করবো। সামান্য সংস্কার করবো। নতুন কমিটি করবো না। হুজুরের দস্তখতে ওই কমিটি হয়েছে। এখন আমির পদ খালি, সবার মতামতের ভিত্তিতে আমির হবেন। যারা হুজুরের আদর্শে বিশ্বাসী, ইসলামি তাহজিব তামাদ্দুনের পথে রয়েছেন, তাদের সমন্বয়েই কমিটি হবে।’

হেফাজতের বাবুনগরীপন্থীদের কমিটিতে রাখা হবে কিনা জানতে চাইলে রুহী বলেন, ‘ওই কমিটি তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমরা তাদেরকেও রাখবো কমিটিতে, এমন পরিকল্পনা আছে। কিন্তু তারা যদি আহ্বায়ক কমিটি বহাল রাখে, তাহলে জাতির কাছে তাদেরকেই দায় বহন করতে হবে। জবাবদিহি তাদের করতে হবে। জাতি এই আহ্বায়ক কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছে।’

জানা গেছে, মধুপুরের পীর মাওলানা আবদুল হামিদ, দেওনার পীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী হেফাজতের শফীপন্থী অংশের আমির/মহাসচিব হতে আগ্রহী আছেন।

এ বিষয়ে মাওলানা আলতাফ হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের উদ্যোগ চলমান আছে। নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যোগাযোগ হচ্ছে। নিরীহ আলেমরা যেন হয়রানি শিকার না হন, কওমি মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার বিষয়ে কাজ করছি। আল্লামা শফীর আদর্শের হেফাজতে ইসলাম শিগগিরই হবে।’

 সভায় বক্তব্য রাখছেন বাবুনগরীহেফাজতের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে এখনও আলোচনা হয়নি

মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলামের পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি হলেও তা এখনও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এমনকি পূর্ণাঙ্গ করার বিষয়ে এখনও আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন কমিটির সদস্য সচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী। এর আগে, হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও মহানগর পর্যায়ের একের পর এক নেতার গ্রেফতারের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ এপ্রিল রাতে সংগঠনটির দ্বিতীয় কমিটি বিলুপ্ত করেন বাবুনগরী।

শুক্রবার দুপুরে হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে এখনও কোনও কথা হয়নি। আলোচনা হয় নাই।’

পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে শফীপন্থী যাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল তাদের রাখা হবে কিনা, এমন প্রশ্নে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সর্বশেষ কমিটিতে তো তারা ছিল না। ফলে তাদের বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে না।’

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আল্লামা আহমদ শফীর ইন্তেকালের কারণে নতুন এ কমিটি করেছিল হেফাজত। এরপর ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী মারা গেলে নায়েবে আমির মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদীকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়েছিল হেফাজত।