কালেরকন্ঠ :

বাংলাদেশে কভিড-১৯ টিকা প্রদানের যাত্রা শুরু হয়েছে। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই টিকা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। আশা করা যায়, সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে। এই টিকার আদ্যোপান্ত নিয়ে আজ প্রকাশিত হলো বিশেষজ্ঞ সাক্ষাৎকার।
কোভিশিল্ড কাদের জন্য প্রযোজ্য? কাদের দেওয়া যাবে না?

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে এখন পর্যন্ত কার্যকর উপায় টিকা গ্রহণ। পৃথিবীতে কয়েক ধরনের টিকা উদ্ভাবিত হলেও বাংলাদেশে দেওয়া হচ্ছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ‘কোভিশিল্ড’। জাতীয় কভিড-১৯ টিকাদান ও কর্ম পরিকল্পনা অনুসারে অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা অনুযায়ী সবাইকে টিকা দেওয়া হবে। ১৮ বছরের কম বয়সী, গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মা, সিভিয়ার এলার্জি, মূমুর্ষূ ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ব্যক্তিদের টিকা দেওয়া হবে না। তবে কোন গর্ভবতী নারী সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকলে তিনি চিকিৎসকের তত্বাবধানে টিকা নিতে পারেন।

এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতটুকু?

ওষুধ হোক বা টিকা—কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতেই পারে। তবে বিশ্বে উদ্ভাবিত কভিড-১৯-এর সব টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই খুব মৃদু প্রকৃতির। টিকা প্রদানের স্থানে সামান্য ব্যথা, ফোলা, লালচে ভাব, মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, দুর্বলতা, বমি বমি ভাব, জ্বর, ক্লান্তি ইত্যাদি ছাড়া এখন পর্যন্ত মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানা যায়নি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে। তবে টিকা দেওয়ার পর কারো কোনো সমস্যা মনে হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে বা চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

মোট কয় ডোজ টিকা গ্রহণ করতে হবে?

কোভিশিল্ড টিকা যাঁরা নেবেন তাঁদের মোট দুই ডোজ গ্রহণ করতে হবে। প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণের আট সপ্তাহের ব্যবধানে পরবর্তী ডোজটি নিতে হবে। পাশাপাশি অন্য কোনো টিকা নিতে বাধা নেই। তবে কমপক্ষে দুই মাস বিরতি দিলে ভালো হবে। কেননা এন্ডিবডি তৈরি হতে এই সময় লাগে।

টিকা নেওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া কি জরুরি?

করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) বলছে, অতীতে যাদের কোনো টিকা নেওয়ার পর বড় ধরনের অ্যালার্জি হয়েছে বা কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তাঁদের টিকা নিতে হলে বিশেষ সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। টিকা নেওয়ার আগে তাঁদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে বা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশে তো টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি—এটা কি কোনো সমস্যা?

বাংলাদেশে কোনো টিকারই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি। এটা কোনো সমস্যাও নয়। কেননা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী প্রথম দফায় ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে নির্দিষ্টসংখ্যক ব্যক্তির ওপর কোভিশিল্ড প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং তাঁদের যথেষ্ট পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে।

একবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হলে তিনিও কি টিকা নেবেন?

জি, তিনিও টিকা নেবেন। একবার কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাঁর দেহে করোনাভাইরাসের যে অ্যান্ডিবডি তৈরি হয় তা মূলত তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে বলে জানা গেছে। তার মানে হলো, তিন থেকে ছয় মাস পর তিনি পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এ জন্য সুস্থ হওয়ার পর ওই ব্যক্তিটির টিকা নেওয়া উচিত, যাতে অন্তত আরো বেশি সময় ধরে সুরক্ষা মিলবে। তবে সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার তিন থেকে চার সপ্তাহ দেরি করে নেওয়া ভালো।

টিকা নেওয়ার পর কি নিয়ম মানতে হবে?

কোনো টিকাই শতভাগ সুরক্ষা দেয় না। দেখা গেছে, ফাইজারের প্রথম ডোজের ১২ দিন পর কার্যকারিতা শুরু হয় এবং আরো পরে সেটা ৫২ শতাংশ কাজ করে। দ্বিতীয় ডোজের এক থেকে দুই সপ্তাহ পর ৯৫ শতাংশ হয়। প্রথম ডোজের দুই সপ্তাহ পর কার্যকারিতা ৫১ শতাংশ, দ্বিতীয় ডোজের দুই সপ্তাহ পর ৯৪ শতাংশ। তাই টিকা দেবার পর ওই ব্যক্তিকে করোনার স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

বেসরকারি পর্যায়ে টিকা প্রদানের অনুমতি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন কি?

যদিও বিত্তবানরা বেসরকারি পর্যায়ে টিকা নিতে চান, তবু বলব এই মুহূর্তে সরকারি পদক্ষেপের বাইরে বেসরকারি পর্যায়ে ভ্যাকসিনের অনুমতি না দেওয়াই ভালো। এতে একটা অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে; তাতে ভেজাল বা নকল টিকার আশঙ্কাও থাকবে। একান্তই বেসরকারি পর্যায়ে অনুমতি দিলেও তা যেন সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি টিকার নির্দিষ্ট দাম বেঁধে দেওয়াসহ পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমার রোগীরা কি টিকা নিতে পারবে?

এসব রোগীদের টিকা নিতে কোন বাধা নেই। তবে তার খুব বেশি গুরুতর হলে নেয়া ঠিক হবে না।

টিকা দেওয়ার পর পর্যবেক্ষণে থাকতে হয় কি?

টিকা নেওয়ার পর সাধারণত কিছু সময় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এ ছাড়া তেমন সতর্কতার প্রয়োজন নেই। এরই মধ্যে বাংলাদেশে টিকা গ্রহণকারীদের কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। শারীরিক জটিলতা বা সমস্যা হলে প্রথমেই হতো, এরপর সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাই অপপ্রচারে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। করোনার যে তাণ্ডবলীলা সেটাই বরং ভয়ের কিছু।

অন্য কোনো সোর্স থেকে ভ্যাকসিন আনা উচিত হবে কি না?

কোভিশিল্ডের বাইরে অন্যান্য ভ্যাকসিনও আনা যায়; কিন্তু বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এটা সংরক্ষণ ও সরবরাহ করা মুশকিল। ফাইজার বা মডার্নার ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করতে হলে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখতে হবে। আর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন রাখা যায় দুই থেকে পাঁচ ডিগ্রির মধ্যে; এমনকি আমাদের নিজস্ব ফ্রিজেও। তাই আমি মনে করি, কোভিশিল্ড আনার সরকারি সিদ্ধান্তটি বাস্তব ও যৌক্তিক।

নিজেকে ও অন্যদের সুরক্ষার জন্য আপনার পরামর্শ কী?

আমি জোর দিয়েই বলব, টিকা নিলেও করোনার স্বাস্থ্যবিধি সবাইকে মেনে চলতে হবে। তাই নাক ও মুখ ভালোভাবে ঢাকতে পারে সবাই এমন মাস্ক পরুন। অন্যদের থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন; ভিড় এড়িয়ে চলুন। দূষিত বাতাস চলাচলকারী স্থানগুলোও এড়িয়ে চলুন। নিয়মিত হ্যান্ডস্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে হাত ধোন।

টিকার রেজিস্ট্রেশন যেভাবে করবেন
♦ করোনার টিকা পেতে আগ্রহীরা সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে www.surokkha.gov.bd গিয়ে অথবা মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করে নিবন্ধনের কাজটি করতে পারবেন। তবে ১৮ বছরের কম বয়সী, গর্ভবতী, দুগ্ধবতী মা, হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা টিকার আওতায় আসবেন না।

♦ প্রথমে এই পোর্টালের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র ও সঠিক মোবাইল নম্বর প্রদানপূর্বক অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করুন। এরপর অনলাইনে ভ্যাকসিন কার্ড সংগ্রহ করুন।

♦ এরপর প্রদানকৃত মোবাইল ফোনে এসমএস-এর মাধ্যমে ভ্যাকসিনেশনের তারিখ ও কেন্দ্র জেনে যাবেন।

♦ ওই পোর্টালের ‘নিবন্ধন স্ট্যাটাস’ মেনু থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর যাচাইপূর্বক নিবন্ধনের অগ্রগতিও জানা যাবে।

♦ কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ সম্পন্ন হওয়ার পর www.surokkha.gov.bd ওয়েব পোর্টালে ‘টিকা সনদ সংগ্রহ’ মেনু বা অপশন থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর যাচাইপূর্বক টিকার সনদ সংগ্রহ করতে পারবেন।

♦ আরো বিস্তারিত তথ্য জানতে কল সেন্টারসমূহের হটলাইন : জাতীয় কল সেন্টার ৩৩৩, স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩, আইইডিসিআর ১০৬৫৫, কভিড-১৯ টেলিহেলথ ০৯৬৬৬৭৭৭২২২।