মোঃ নিজাম উদ্দিন, চকরিয়া:
চকরিয়ায় সিজারিং ছাড়া নরমাল ডেলিভারি সেবার প্রতি দিনদিন আগ্রহ বাড়ছে সাধারণ জনগণের। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রের মাধ্যমে বিনামূল্যে দিচ্ছে এসব সেবা। এর প্রভাবে ধ্বস নামছে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর সিজারিং ব্যবসায়।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন’ ২০১৯ সালের জুনে দেয়া তথ্যমতে বেসরকারি হাসপাতালে সিজারের হার ৮৩ শতাংশ, সরকারিতে ৩৫ শতাংশ ও এনজিও হাসপাতালে ৩৯ শতাংশ। গ্রামের চেয়ে শহরে হার তুলনামূলক বেশি। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ রয়েছে একপ্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায়। সর্বাধিক হাসপাতাল ক্লিনিকগুলো ছিল জনশূন্য। ঠিক এসময়ে সিজারে বাচ্চা প্রসবের হার অনেক অংশে কমে গেছে। তবে আশ্চর্য বিষয় হলো, বাড়েনি প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর হার। এর থেকেই প্রমাণ হয়, বিনা প্রয়োজনে অসংখ্য সিজারের ঘটনা ঘটছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে।
গত ২০১৯ সালের জুন মাসে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এনিয়ে তিনি জানান, কেবল আর্থিক সুবিধার জন্যই হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ প্রসূতি মায়েদের সিজার করাতে বাধ্য করেন। দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্লিনিক এই কাজ শুধু টাকার জন্য করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর আয়ের অন্যতম উৎস এই সিজারিয়ান ডেলিভারি। একপ্রকার অসাধু চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সমঝোতায় চলে এই কার্যক্রম। প্রয়োজন ছাড়া প্রসূতী বা অভিভাবকদের ভুলভাল বুঝিয়ে বাধ্য করায় সিজারিয়ান ডেলিভারিতে। অনেক সময় তারা সাধারণ বিষয়কে জটিল করে বুঝিয়ে দিয়ে মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দিচ্ছে। শেষপর্যন্ত তারা বাধ্য হয় সিজারিয়ান ডেলিভারিতে।
অনেকসময় দেখা যাচ্ছে, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে নরমাল বা সিজার ডেলিভারি নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা। বৃদ্ধি পাচ্ছে ‘বিশেষ ছাড়’ ও ‘ফ্রি’ নামের মনভুলানো প্রচারণা। এ নিয়ে গ্রাম গঞ্জের অলি-গলি ভরে গেছে রংবেরঙের লিফলেট আর পোষ্টারে। মাইকিং চালাতেও দেখা যায় গ্রামের পথেঘাটে। এছাড়া সরকারি সেবাদান কেন্দ্রগুলোর আশপাশে এলাকায় ঘুরঘুর করছে দালাল চক্র। তাদের খপ্পরে সর্বস্ব হারিয়ে সিজার ডেলিভারিতে মা-শিশুর মৃত্যু হয়েছে অহরহ। কিন্তু সম্প্রতি চকরিয়ায় এসব প্রচারণা ও দালাল প্রবণতা কমে যাওয়ার চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত কিছুদিন আগপর্যন্ত মাত্র আড়াই মাসে এক’শ শিশু জন্মলাভ করেছে শুধুমাত্র সিজারিয়ান ছাড়া। এ প্রসূতি মা’দের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ সেবা দেয়া হয়েছে। একইভাবে সেবা পাচ্ছে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে। গত দশ মাসে ডুলাহাজারা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও নরমালে ভূমিষ্ট হয়েছে এক’শ শিশু। এসব সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে উন্নত সেবা পেয়ে এখন সন্তুষ্ট উপজেলার জনগণ। এখান থেকে সুশৃঙ্খল ডেলিভারি সেবা নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরছে প্রসূতি মায়েরা। এতে প্রভাব পড়তে লক্ষ্য করা গেছে বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর উপর। অতিরিক্ত অর্থ ব্যায় ও প্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের কারণে প্রসূতি মায়েরা এখন দিনদিন বিমুখ হচ্ছে এসব বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতি। এতে কমে আসছে তাদের অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানে আয়ের সুযোগ। যারফলে প্রতারণার কবল থেকে অনেকটাই রক্ষা পাচ্ছে সাধারণ জনগণ।
চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোহাম্মদুল হক বলেন, ‘একটা সময় চকরিয়া সরকারী হাসপাতালে প্রসূতি মায়েদের নরমাল ডেলিভারি করানো প্রায়ই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চলতি বছরের জুলাই মাসে আমি যোগদানের পর আমরা সবাই মিলে টিম ওয়ার্ক শুরু করি। দালাল চক্রের কিংবা দায়মা-দের বাধা উপেক্ষা করে এর সফলতা পেয়েছি। একই ভাবে প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিও নির্দেশনা রয়েছে। আমাদের প্রচেষ্টা ও জনগণের আগ্রহের কারণে প্রসূতি মায়েরা নরমাল ডেলিভারির প্রতি দিনদিন আগ্রহ বাড়ছে।’ এ ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখে জনগণ যথার্থ সেবা পেতে তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।