রেজাউল করিম চৌধুরীঃ
কক্সবাজারের কিংবদন্তি নেতা অ্যাডভোকেট জহির মামা কিছুদিন আগে মারা গেছেন, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন। আমি তাঁকে মামা ডাকতাম, কারণ মাতৃকূলের দিক থেকে আমাদের মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিলো। তাছাড়া আমাদের সংস্কৃতিতে একজন সম্মানিত প্রবীণ ব্যক্তিকে “মামা” সম্বোধন করা হয়ে থাকে।

তিনি কক্সবাজার থেকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত অন্যতম নেতা, আমরা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের চার নীতি – গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর প্রজ্ঞার জন্য জানি। আমাদের অবশ্যই এই চার নীতির মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এই নীতিগুলো বেছে নিয়েছিলেন, তিনি কখনও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ প্রচার করেননি।

নীতিতে অটল থাকার জন্য আমরা এডভোকেট জহিরকে জানি, তিনি তাঁর দীর্ঘজীবনে তার রাজনৈতিক অবস্থানে ছিলেন আপোষহীন। তিনি তাঁর এই গুণাবলীর জন্য সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় ছিলেন, তার সম্পদ বা অন্যকিছুর জন্য নয়, তাঁর বা তার পরিবারের এমন সম্পদও নেই যেগুলো তাঁকে বিখ্যাত করে তুলবে।

সম্ভবত ১৯৬৭ সাল থেকে আমি তাঁকে জানি। তৎকালীন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা নজরুল মামা (এখনও তিনি জীবিত, যদিও তিনি অসুস্থ) আমাকে প্রথম হোটেল রিভার ভিউতে আওয়ামী লীগের ছয় দফার বিষয়ে আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তৎকালীন আরেক ছাত্র নেতা জনাব কামালের সাথে আমার এই বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে (পরে দেখলাম তিনি শহরে সাহিত্যিকা কামাল নামে বিখ্যাত ছিলেন)। তাদের এই শিক্ষাদান মুক্তিযুদ্ধের এই চারটি নীতিমালা বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ে কক্সবাজারের ছাত্রদের উদ্দীপ্ত করেছিল।

এদের সবারই দিক-নির্দেশক এবং দীক্ষাগুরু ছিলেন তৎকালীন কক্সবাজার আওয়ামী লীগের অন্যতম মূল সংগঠক অ্যাডভোকেট জহির। তিনি আমাকে চিনতেন, কারণ আমি ছিলাম তাঁর আত্মীয়, তাছাড়া আমার বাবার কারণেও তিনি আমাকে বিশেষভাবে জানতেন। আমার বাবা বেশিরভাগ সময় ক্ষমতার সপক্ষের বা ডানপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, তবে অ্যাডভোকেট জহির সর্বদা প্রতিষ্ঠা-বিরোধী ফ্রন্টে ছিলেন, সারা জীবনই, আপোষহীনভাবে। ১৯৭০ এর দিকে তিনি আমাকে পর্যটন মোটেলে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর রুমে একটি খাটে কোলের উপর একটি বালিশ ধরে বসে ছিলেন, তাঁর গায়ে ছিলো সাধারণ লুঙ্গি এবং গেঞ্জি। আমরা তার সাথে এক খাটে বসেই নাস্তা করলাম। বঙ্গবন্ধু আমার বাবাকে চিনতেন, আমাদের পরিবারের খোঁজ খবর নিলেন। পরে বিকেলে আমরা তার নির্বাচনী জনসভায় যোগ দিয়েছি।

অ্যাডভোকেট জহিরের মতো সেই সময়কার কক্সবাজারের অন্যান্য সকল রাজনৈতিক নেতারই উৎপত্তি কৃষি অর্থনীতির পটভূমিতে, আধা-সামন্তবাদী পরিবার থেকে। যদিও আমার বাবার মতো তাদের বেশিরভাগই মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতি মোহাচ্ছন্ন ছিলেন, তবে অ্যাডভোকেট জহির এবং আরও অল্প কয়েকজন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে, বিশেষ করে সমতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে নিজেদেরকে যুক্ত করেছিলেন। আমি তাদের সবার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে দেখেছি, কক্সবাজারের মতো ছোট একটি শহরে তাঁরা ছিলেন একই পরিবারের সদস্যের মতো।

তাদের সাথে আলাপচারিতা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই সময়ে কক্সবাজারের “তথাকথিত” অভিজাত শ্রেণিতে বেশিরভাগই ছিলেন অ্যাডভোকেট এবং ঠিকাদারেরা। আমি তখনকার শহরটির কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। পূর্বাংশে ছিলো উম্মে স্টোর এবং ভোলা বাবুর পেট্রোল পাম্প, উত্তর দিকে কস্তুরা ঘাট, পশ্চিম দিকে সমূদ্র পাড়ে ছিলো আমার বাবার রেস্ট হাউস, কস্তুরা ঘাটের পাশে ছিলো রিভার ভিউ হোটেল, মাঝখানে ছিলো ডিসেন্ট টেইলার্স ও প্যারাডাইজ স্টোর, দক্ষিণ- পশ্চচিমে সাগর পাড়ে ছিলো পর্যটন সাগরিকা। আমার এখনও পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ঝাওগাছ ভর্তি লম্বা রাস্তাটির কথা মনে পড়ে। একইভাবে আমার স্পষ্ট মনে আছে, কক্সবাজারের উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ খুব সহজ সরল জীবন যাপন করতেন, তাঁরা একে অপরের প্রতি ছিলেন খুব শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের একটি জিনিস আমার হৃদয়ে ভীষণভাবে দাগ কাটে, তাঁরা নিজেদেরকে সবসময় আমলাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবতেন।

আমি রংপুরে একবার অ্যাডভোকেট জহিরের সাথে দেখা করেছি, সম্ভবত ১৯৯২ সালে। তিনি তখন একটি জনসভায় যোগ দিতে ডক্টর কামাল হোসেনের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন। আমি সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রকল্পে পরামর্শক হিসাবে কাজ করছিলাম। সেই দেখাতে আমরা আবার মুক্তিযুদ্ধের সেই চারটি মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি; সেই দর্শনগুলির বিষয়ে তাঁর দৃঢ়তার কথা মনে পড়ে। ১৯৯৪ সালের শেষভাগে আমি ভোলায় চলে যাই, পরে কক্সবাজারে চলে এসেছি এবং শেষ পর্যন্ত আমরা ২০১১ সালের পরে ঢাকায় চলে আসি। মাঝখানের এই সময়টায় অ্যাডভোকেট জহিরের সাথে আমার তাই যোগাযোগ ছিলো বিক্ষিপ্ত, খুব কম।

রেজাউল করিম চৌধুরী
নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট

কক্সবাজারবাসীর জন্য এডভোকেট জহির মামাকে নিয়ে কিছু লিখতে আমার দু’দিন লেগে গেলো। আমি আসলে লিখতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ কক্সবাজারের মুক্তিযুদ্ধের দর্শনভিত্তিক মর্যাদা ও শক্তি পুনরুদ্ধার করা দরকার। সর্বোপরি আমাদের নেতাদের এবং নতুন প্রজন্মকে বলা উচিত যে, তাঁকে জনগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে। তাঁর অর্থ এবং সম্পদের জন্য নয়, তাঁর নিজের নীতিগত অবস্থান এবং অবিচলতার জন্য তিনি বরং সবার কাছে পরিচিত। কক্সবাজারবাসীর প্রকৃতি, সরলতা, সহনশীলতা এবং মিথস্ক্রিয়ার সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার করা দরকার। শুধু টাকা দিয়ে সব হয় না, আমরা টাকা খেতে পারি না।

অ্যাডভোকেট জহির মামা, আমি আপনার কাছ থেকে সাম্য, মানবাধিকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি শিখেছি, দীর্ঘ সময় ধরে এই দর্শনের জন্য আওয়াজ তোলার আশীর্বাদ কামনা করে আপনার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবো।

আমার প্রিয় কক্সবাজারবাসী, আমাদের ভবিষ্যত হোক সমতা, মানবাধিকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার।

রেজাউল করিম চৌধুরী
নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট।