অধ্যাপক আকতার চৌধুরী

(করোনা ডায়েরী-১০ম পর্ব )

করোনা মানুষের চিন্তা চেতনায় আমূল পরিবর্তন এনেছে । বলতে পারেন একেবারে উল্টোরথ যাত্রা ।

মোটিভেশনাল স্পিচে কে জানি বলেছিল ,- “পজেটিভ ভাবতে শিখুন, জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারবেন।”

এখন পজেটিভ বললেই মানুষ ভয় পায় । দুরে পালিয়ে যায়। মহল্লাচ্যুত , সমাজচ্যুত , পাড়াচ্যুত , ফ্লাটচ্যুত , বাসাচ্যুত করে দেয় । যেন অসামাজিক কার্যকলাপের দায়ে একঘরে করে ফেলা।

কিন্তু আমাদের জীবনে এত নেগেটিভিটি কল্পনাও করা যায় না। কারো ভাল চাওয়া লোকের পরিমাণ খুব কম। সবাই যে যার অবস্থান থেকে কানামাচি , হা-ডু-ডু , ল্যাং মারামারি খেলছি। কাকে কিভাবে ফেলব , কাকে কিভাবে ঠেকাব, এটা নিয়েই ব্যস্ত সবাই। কাউকে নিয়ে ভাল চিন্তা , বা পজেটিভ চিন্তার সময় কারো নেই। নেগেটিভ বা অমঙ্গল চিন্তা ধারণা আমাদের অস্থিমজ্জায়। কিন্তু এক করোনা আমাদের নেগেটিভ ভাবতে বাধ্য করেছে।

এখন আমরা ভাবনায় চিন্তায় চেতনায় নেগেটিভ চাই । কেউ চায় না করোনা পজেটিভ হোক। করোনা এমনই রোগ রোগী দেখলে ডাক্তার পালায় । পজেটিভ হলে স্বামী- স্ত্রী , মা -বাবা , ভাই -বোন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ কারো নয় । এক বিছানার লোকগুলোও অপরিচিত হয়ে যায়। আর করোনা মরণ মানে করুণ মরণ,  কবর দেয়ার মানুষও পাওয়া যায় না !

কিছুদিন আগে দেখলাম এমন সব ঘটনা ।

গত ১৭ এপ্রিল থেকে ভাইরাল হয়ে ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল একটা ছবি । সবার চোখ আটকে যাচ্ছে অসহায় এক বাবার সন্তানকে কোলে করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। বাকীদের নির্বিকার দাড়িয়ে থাকা। ছবিটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। বাচ্চাটার করোনা পজিটিভ। রংপুরের স্কুল ছাত্র।  মহামারী করোনা কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত । জরুরীভাবে ঢাকার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। হাসপাতালের বাইরে এম্বুলেন্স পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য স্ট্রেচার প্রয়োজন, স্ট্রেচারটাও দিলনা। ডাক্তার নার্স ওয়ার্ডবয় কেউ এগিয়ে এলেন না। তাদেরও ভয় ,যদি তারাও সংক্রমিত হয়।

কিন্তু বাবা বলে কথা । দুনিয়ার সমস্ত আবেগ অনুভূতি স্নেহ মায়া মমতা ভালবাসা সন্তানের প্রতি। কিসের করোনা ! করোনাকে করুণা করি।

বাবা ছেলেকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটছে । যেন বলছে –
‘আরে বেটা ভয় কিসের! এই দেশ মইরা গেছে অনেক আগেই, কিন্তু তোর বাপ এখনো বেঁচে আছে।

বাবাতো বাবাই ! মা’তো মা’ই । সন্তান বাবাকে ফেলে যেতে পারে , কিন্তু বাবা না !

ক’দিন আগেও করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত ৬ বছরের ছেলের লাশ এক বাবা কোলে নিয়ে কবরস্থ করলো। বাবার ভালবাসার কাছে হার মানল মহামারী করোনা।

অথচ পত্রিকায় প্রায়ই উঠে আসে, বৃদ্ধ মা-বাবার করোনা হয়েছে ভেবে বনে জঙ্গলে অথবা হাসপাতালের সামনে ফেলে চলে গেছে সন্তান! এটাই মা-বাবা এবং সন্তানের মধ্যে পার্থক্য।

এই কঠিন সময়ে  ১০ মে হয়ে গেল বিশ্ব ‘মা’ দিবস । মা দিবসের অনেক ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা দুনিয়ার সকল মায়ের প্রতি – সাথে বাবার প্রতি।

মাত্র ২ মাস আগের কথা এখন মনে পড়লে হাসি পায় । করোনার প্রথম ক’টা দিন এক অন্য রকম পরিবেশে কেটেছিল। যার সাথে দেখা ,অনুতপ্ত কন্ঠে একটাই কথা শুনেছি – “ভাই , ভাল মন্দ মাফ করে দিয়েন ” “যদি কোন ভুল করে থাকি মাফ চাই” “বেঁচে থাকলে আপনার পাওনাটা দিয়ে দেব এবার” “যদি মারা যাই মাফ করে দিয়েন”। যেন মাফ চাওয়ার প্রতিযোগিতা । অনন্ত অসীমের পথে ওপারে চলে যাওয়ার প্রাক প্রস্তুতি গ্রহণ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মানুষের চরিত্র পূর্বে ফিরেছে। পরিবার , পরিজন, প্রতিবেশী , সমাজ , রাজনীতি সেই ব্যাক টু দ্যা পেভিলিয়ন। এতবড় মহামারী আমরা কিছু শিক্ষা নিতে পারলাম কই !

তবে চলে যায়নি করোনা। বাড়ছে রোগী , বাড়ছে ঝুঁকি।

কিছু ফার্মেসীওয়ালাদের কী দৌরাত্ন্য ছিল সেদিন ! মনে পড়লে তাদেরকে একটু দেখে আসতে ইচ্ছে করে তাদের চেহারায় কোন অনুতাপের চিহ্ন আছে কিনা! মাস্ক , গ্লাভস , সেনিটাইজার চাইতে গেলে এমন ভঙ্গি এসব জিনিস পৃথিবী থেকে ডায়নোসরের মত কবে উধাও হয়ে গেছে! একটু সরে আসতেই দেখলাম চড়া দামে আরেকজনকে বের করে দিচ্ছে। শুধূ কি তাই , নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশ ছোঁয়া দাম। পঁচা পেয়াজেরও তেজ বেড়ে গেল। মুদির দোকান , কাচা বাজারের আরো করুন অবস্থা । যোগান নাই দাম তো বাড়বেই। কিন্তু যা স্টকে ছিল তার কেন দাম বাড়বে!  সে সময়টাও পার করে এলাম।

শহরে জরুরী খাদ্যের প্রয়োজনে এখন বাইরে বেরোলে টমটম রিকসার জ্যাম। মানুষের মেলামেশাও স্বাভাবিক । হাতে গোনা কয়েক জনের মুখে মাস্ক গ্লাভস। আপনি একা সতর্ক হয়ে হাট বাজারে নিজেকে রক্ষার সুযোগ নেই। যেন সামাজিক দুরত্ব বলেছে সরকার , শারীরিক দুরত্ব তো বলে নাই । তাই মানুষে মানুষে ঘেষাঘেষি ।  দুর পাল্লার বাস ছাড়া অন্যান্য যানবাহনও স্বাভাবিক।

১০মে থেকে সীমিত আকারে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শপিং মল, মার্কেট, হাট-বাজার খোলা রাখতে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেভাবে দেশে কোথাও কোথাও শপিংমল , দোকান খোলাও হয়েছে। পুরুষের চেয়ে মহিলাদের ভীড় বেশি। যেন অনেকদিন মার্কেটিং করতে পারি নাই তা এ সুযোগে মিটিয়ে নেব।  যৌক্তিক  কারণেরও শেষ নাই । বাচ্চাদের তো আর বোঝাতে পারছিনা , তাই নতুন জামা কাপড় কিনতে আসা।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যাতে না বাড়ে সেজন্য সারাদেশে প্রায় ৯৫ শতাংশ শপিংমল বন্ধ থাকবে। এটা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য চিন্তা । কারণ এমনই অবস্থা , নিজের গরজে নিজের ঠেকায় বাঁচতে হবে।
তারই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজার জেলা ব্যাপি বিশেষ করে চকরিয়া , টেকনাফ , উখিয়া ও কক্সবাজার শহরে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স , বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি , দোকান মালিক সমিতি ফেডারেশন , ব্রাদার্স ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির মার্কেট ও দোকান আগামী ঈদ পর্যন্ত না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।অনেক মার্কেট মালিক ভাড়াও মওকুফ করেছেন। এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। তারা বুঝতে পেরেছে ,জীবিকার চেয়ে জীবনের মুল্য অনেক বেশী ।

তবে কক্সবাজারে এ সচেতনতা শুরু হয় স্বাধীন মঞ্চ নামে চকরিয়ার একটি সামাজিক সংগঠনের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে। এই চকরিয়াও
জেলায় এখন করোনার হটস্পটে পরিণত হয়েছে  । কক্সবাজারের প্রবেশ দ্বার চকরিয়ায় করোনা ঠেকাতে গিয়ে করোনা পজেটিভ হয়েছেন চকরিয়া এসি ল্যান্ড তানভীর হোসাইন এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী । এ তালিকা হয়তো আরো বড় হবে।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে রোববার ১০ মে ১২৫ জনের স্যাম্পল টেস্টের মধ্যে ১০ জনের রিপোর্ট ‘পজেটিভ’ পাওয়া গেছে । এরমধ্যে চকরিয়া উপজেলায় ২৫ জন করোনা রোগী নিয়ে জেলার শীর্ষে , কক্সবাজার সদর উপজেলায় ২২ জন নিয়ে ২য় স্থানে , পেকুয়া উপজেলায় ১৪ জন, মহেশখালী উপজেলায় ১২ জন, উখিয়া উপজেলায় ৮ জন, টেকনাফ উপজেলায় ৬ জন এবং রামু উপজেলায় ৪ জন। কুতুবদিয়া উপজেলায় এখনো কোন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত  হয়নি। এ সফলতায় নাম যুক্ত হয়েছে কুতুবদিয়ার ওসি দিদারুল দিদারুল ফেরদৌসের নাম। জেলাব্যাপী পুলিশের  ভূমিকা ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সত্যি এক মানবিক পুলিশকে দেখল জেলাবাসী। তাদের ভূমিকা নিয়ে অন্যদিন লেখার ইচ্ছে পোষণ করছি। কক্সবাজার জেলায় প্রথম মৃত্যু রামু উপজেলায় ।

এছাড়া দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৪ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ২২৮।  আক্রান্ত আরও ৮৮৭ জন শনাক্ত। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১৪ হাজার ৬৫৭ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে করোনা রোগী ।

টানা ২ মাসের লক ডাউনে মানুষ অনেকটা নির্জীব হয়ে পড়েছে। অর্ধাহারে অনাহারে  দাবী উঠেছে লক ডাউন শিথিলের । দাবী উঠেছে যানবাহন চলাচলের । দাবী উঠেছে অফিস আদালত খুলে দেয়ার ।  গার্মেন্টস খুলে দেয়ার । দাবী উঠেছে মসজিদ খুলে দেয়ার , তারাবির নামাজের । দাবী উঠেছে নিম্ন বিত্তের পাশাপাশি  মধ্যবিত্তের জন্য রিলিফের ব্যবস্থা । যেটাকে আমরা ভদ্রভাবে নামে দিয়েছি “উপহার”। দাবী উঠেছে চিকিৎসার। দাবী উঠেছে টেষ্ট বাড়ানোর। দাবী উঠেছে করোনা হাসপাতালের ।  সরকার  অনেক দাবী মেনেও নিয়েছেন।

চেক এন্ড ব্যালেন্স করছেন সরকার । না করেও উপায় নেই। সকল পক্ষের কথাও শুনছেন। এর মধ্যে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে দোষারোপের রাজনীতিও চালু আছে। রিলিফ বিতরণে অনিয়ম আত্মসাতের ঘটনাও ঘটছে। ক্লিন কক্সবাজারে রিলিফ আত্মসাতের ঘটনাটা পেকুয়ার কপালে জুটেছে।

তবে কৃষকের ধান কেটে দিয়ে , লবণ তুলে দিয়ে  অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের বিভিন্ন শাখাগুলো। ভ্রাম্যমাণ  হাসপাতালের মত মহৎ কর্মে এই ছাত্রলীগেরও অংশগ্রহণ আছে। করোনায় ভিন্ন এক ইমেজে ছাত্রলীগকে দেখল জাতি।

জীবনের জন্য  জীবিকা , নাকি জীবিকার জন্য জীবন এ নিয়ে অনেক তর্ক  থাকতে পারে। তবে জীবিকার জন্য জীবন বিপন্ন হলে সে জীবিকাকে বাধাগ্রস্থ করা ও  জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা  সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।

কিন্তু প্রশ্নটা সে জায়গায় ,- যেখানে বিশ্বে লক ডাউন তখনই শিথিল ঘোষণা করা হয়েছে যখন করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে গেছে । আমাদের দেশে হয়েছে উল্টোটাই। এ যেন “যদি লাইগা যায়” লটারির মত। এটা শ্রেফ জুয়ার চাল । করোনা জুয়া !
। এই চালে ভাগ্যের জোরে জিতে গেলেতো কথা নেই , ছক্কা হাকালাম। , হারলে কিন্তু অক্কা , মহা বিপর্যয়!

মনে রাখতে হবে, লক ডাউন শিথিল হয়েছে বটে , করোনা শিথিল হয় নাই!

 

লেখক : সম্পাদক , কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন) ।