মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

আবদুর রশিদ। জন্ম থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। উখিয়ার রত্নাপালং ইউনিয়নের বাসিন্দা। বয়স প্রায় ৪৫ বছর। ১৩ বছরের একটা কিশোরের সহায়তায় কক্সবাজার শহরে ভিক্ষা করে সংসার চালায়। করোনা ভাইরাস জনিত সংকটের আগে শহরের একটা নিন্মমানের রেস্টুরেন্টের মালিকের অনেকটা দয়ায় নামমাত্র মূল্যে তিন বেলা তার সহকারী সহ খানা খেতো। কক্সবাজার পৌরসভার মোড়ে ফুটপাতে রাত্রি যাপন করে তারা। করোনা সংকট শুরু হওয়ায় জনম অন্ধ আবদুর রশিদও তার রাতের খাবার নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়ে যায়।

গত ২৯ মার্চ থেকে অন্ধ আবদুর রশিদের সে সমস্যা কেটে গিয়ে খুলে যায় তারা দু’জনের কপাল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর পরই অন্ধ আবদুর রশিদ ও তার সহকারীর হাতে পৌঁছে যায় গরম গরম ডিমসহ খিচুড়ির পেকেট, বিশুদ্ধ পানির বোতল। আবার যারা দিতে আসেন, তাদের কাছ থেকে পরদিন সকালে খাওয়ার জন্য অতিরিক্ত দু’টি পেকেট চাইলেও তারা দিতে কার্পণ্য করেন না। গত ২৩ দিন ধরে এভাবেই চলছে অন্ধ আবদুর রশিদ ও তার সহকারীর রাত ও সকালের খাবার। গত ২৩ দিনে এটা অন্ধ আবদুর রশিদের জন্য একটা নিয়মে পরিনত হয়েছে। এ খাবার যেন, অন্ধ আবদুর রশিদের জন্য আমৃতসূধা। কিন্তু সোমবার ২১ এপ্রিল রাত প্রায় ৮ টা। অন্ধ আবদুর রশিদের জন্য রান্নাকরা খাবার তখনো পৌঁছায়নি। অন্ধ আবদুর রশিদ তাই ১০/১২ মিনিট পর পর তার সহকারীর কাছ থেকে বার বার জানতে চাচ্ছিলো, আঞ্চলিক ভাষায় “আজিয়্যা পুলিশ ন আইয়্যের কা”। অর্থাৎ “আজকে পুলিশ আসছেনা কেন”?

সোমবার রাতে এরকম বলতে বলতেই অন্ধ আবদুর রশিদ ও তার সহকারীর হাতে পৌঁছে যায়, গরম গরম ডিমসহ খিচুড়ির পেকেট ও বিশুদ্ধ পানির বোতল। সাথে একটা মাস্ক। এভাবে অন্ধ আবদুর রশিদের মতো প্রতিদিন রাতে আড়াইশ থেকে তিনশো পর্যন্ত গরম গরম ডিমসহ খিচুড়ির পেকেট, বিশুদ্ধ পানির বোতল পৌঁছানো হয় ভবঘুরে, নিরন্ন, ফুটপাতে থাকা অসহায় মানুষ, ভিক্ষুক, সহায় সম্বলহীন দুঃস্থ সহ একেবারে মানহীন জীবনযাপনে যারা অভ্যস্থ তাদের কাছে। আর এই রান্নাকরা খাবারের পেকেট, বিশুদ্ধ পানির বোতল সহ পৌঁছাচ্ছে পুলিশ নারী কল্যান সমিতি (পুনাক), কক্সবাজার জেলা শাখা। গত ২৯ মার্চ থেকে এ মানবিক কার্যক্রম শুরু করেছে জেলা পুনাক।

কক্সবাজার শহরে প্রতিরাতে পুনাক কক্সবাজার জেলা শাখার উদ্যোগে করোনা ভাইরাসজনিত পরিস্থিতির কারণে চরম খাদ্য সংকটে পড়া কক্সবাজার জেলা শহরের প্রতি রাতে আড়াইশ’ থেকে তিনশো জন পথশিশু, ভবঘুরে, দুঃস্থ, অসহায়, নিন্ম আয়ের মানুষ, নিরন্ন লোকজন ও গরীব মানুষের মাঝে তৈরীকরা রাতের খাবার বিতরণ গত ২৯ মার্চ থেকে অব্যাহত রেখেছে।

এটা একটা বিশাল মানবিক সহায়তা কর্মসূচী। যে পুলিশের বিরুদ্ধে শুধু অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নেওয়া ও বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডে জড়িত হওয়ার বার বার অভিযোগ তোলা হয়, সেই পুলিশই আজ নিজে ও নিজের পরিবারের সদস্যদের জীবনের চরম ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সেবা দিচ্ছে দিন রাত ২৪ ঘন্টা।

কক্সবাজার জেলা পুনাক’র এর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এ কার্যক্রম যতদিন মানুষকে বাড়ি ঘরে অবস্থানের সরকারি নির্দেশনা থাকবে, কক্সবাজার লকডাউন (Lockdown) থাকবে ততদিন চলবে। প্রথম দিন সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম (বার) এ মানবিক কার্যক্রমের শুভ সূচনা করেন। সোমবার ২১ এপ্রিল পর্যন্ত পুনাক গত ২৪ দিনে ছয় সহস্রাধিক পেকেট এরকম রান্নাকরা খাবারের পেকেট ও বিশুদ্ধ পানির বোতল, মাস্ক বিতরণ করেছে।

সুত্রটি আরো জানায়, কক্সবাজার জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁদের ব্যক্তিগত অনুদান দিয়ে করোনা ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারীতে খাদ্য সংকটে পড়া অসহায় মানুষের জন্য এ তহবিল গঠন করেছে। যাতে কোন সরকারি সহায়তা নেই।

প্রসঙ্গত, পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম (বার) এর সহধর্মিণী জেনিফার মাসুদ পদাধিকার বলে পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক) এর কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন এর সহধর্মিণী ডা. সাদিয়া জামান হোসাইন জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) রেজওয়ান আহমেদের সহধর্মিণী ফাতেমা হক জয়া আহমেদ জ্যেষ্ঠ সদস্য।