ইমাম খাইর, সিবিএন:
শুধু শুধু দোকানে বসরা বসিয়ে ব্যবসা নয়, পাল্টেছে সেই পুরনো ধ্যান-ধারণা। দিনদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন প্রযুক্তি। বদলাচ্ছে ব্যবসার চিন্তাধারা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল এগুচ্ছে বাংলাদেশও। ই-কমার্স, ই-সেবা ছড়িয়ে যাচ্ছে গ্রামে গঞ্জে।
২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল কক্সবাজারের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মহেশখালীকে দেশের প্রথম ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ হিসেবে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ডিজিটাল দ্বীপ প্রকল্পে উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমাধানের ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ চলছে। প্রায় ৩৬২ দশমিক ১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মহেশখালী দ্বীপের ৩ লাখ বাসিন্দার জীবনমানের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সরকার।
প্রাথমিকভাবে মহেশখালী পৌরসভা এবং উপজেলার ছোটমহেশখালী ও বড়মহেশখালী ইউনিয়নের ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্পটি দেশের দ্রুততম ইন্টারনেট গতির মাধ্যমে মহেশখালীকে একটি বিচ্ছিন্ন উপদ্বীপ থেকে একটি উদীয়মান প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসাবে রূপান্তর করতে সহায়তা করছে। এই প্রকল্পটি আইওএম বাংলাদেশ মিশনের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প।
আইওএম, কোরিয়া টেলিকম, বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল যৌথভাবে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পটির অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে মহেশখালীতে বিদ্যমান একটি টাওয়ার সংস্কার এবং গিগা মাইক্রোওয়েভ স্থাপন, যার ফলে মহেশখালীর বাসিন্দারা ১০০ এমবিপিএসেরও বেশি গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছেন।
‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্প একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত:
দ্বীপর উপজেলা মহেশখালীর গোরঘাটায় দিদারুল ইসলাম এবং হোয়ানকের মারুফা নাসরিন লোপা, তারা দুইজনই তরুণ উদ্যোক্তা। তাদের মতো আরো ৯ জন উদ্যোক্তা মিলে ই-কমার্সের মাধ্যমে মহেশখালীর বিষমুক্ত শুটকি সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাতে নিজেরা যেমন স্বাবলম্বি হওয়ার পাশাপাশি এলাকার অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। এক সময়ের পিছিয়ে থাকা মহেশখালীর স্বপ্নের মতো করে এগুচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্র থেকে জানা গেছে, উদ্যোক্ত সৃষ্টির জন্য দ্বীপের ৯ জন শুকটি ব্যবসায়ীর প্রতিজনকে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা করে অফেরতযোগ্য আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে আইওএম। এসব লোকদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সবাই শুকটিতে নিজেদের জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছে।
উদ্যোক্তা মারুফা নাসরিন লোপা জানান-মৎস্য উৎপাদনকারীদের বিষমুক্ত শুটকি উৎপাদন করে। তারা প্রথমে মৎস্যজীবীদের সু-শিক্ষা দিচ্ছে। তারপর তাদের কাছ থেকে বিষমুক্ত শুটকি নিয়ে ই-কমার্সের মাধ্যমে তারা সারা দেশে বিক্রি করছে। মহেশখালীতে বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও তাদের কাছ থেকে শুটকি কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
এসবই সম্ভব হয়েছে দ্রুতগতির ইন্টারনেট গতির মাধ্যমে ই-সেবা দিয়ে মহেশখালীকে ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসার কারণে। ডিজিটাল আইল্যান্ড হিসেবে মহেশখালীকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সেবা দেয়া হচ্ছে।
গত ২৭ জানুয়ারী আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর মিডিয়া ট্যুরের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের একদল সাংবাদিক ডিজিটাল আইল্যান্ড পরিদর্শন করেন।
এ সময় বিভিন্ন ই-সেবা, ই-কমার্স সেন্টার সিস্টেম দেখেন। কথা বলেন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে।

ডিজিটাল আইল্যান্ড পরিদর্শনে কক্সবাজারের মিডিয়াটিমের একটি অংশ। সঙ্গে রয়েছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর এর প্রতিনিধিরা।

সংস্থাটির ডিজিটাল আইল্যান্ডের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার এমডি রেজাউল আল মাসুম, ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার তারেক মাহমুদ জানিয়েছেন -তথ্য প্রযুক্তির সেবা গ্রামের তৃনমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে পাইলট প্রকল্প হিসেবে মহেশখালী দ্বীপকেই বেছে নিয়ে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ই-সেবা শুরু করেছে বর্তমান সরকার।
কীটনাশক এবং সংরক্ষণকারী রাসায়নিক উপকরণগুলোর ব্যবহার কমিয়ে স্থানীয়দের জৈব কৃষি এবং অর্গানিক পদ্ধতিতে মাছ শুকানোতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশপাশি ই-কমার্সের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে আয় বাড়ানো ও মধ্যস্বত্তভোগীদের দৌরাত্ম্য দূর করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
আইওএম -এর ট্রানজিশন রিকভারি ডিভিশন (টিআরডি) এর প্রধান পেট্রিক শেরিগনন জানান-মহেশখালী দ্বীপটিকে এই প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল কারণ এটি বাংলাদেশের অন্যতম স্বল্প-উন্নত জনগোষ্ঠী। এখানে নিরক্ষরতার হার বেশি এবং মাটির লবণাক্ততা কৃষিফলনকে বাধাগ্রস্থ করে। স্থানীয় যুবসমাজ দ্বীপ থেকে স্থানান্তরিত হচ্ছে এর ফলে এই দ্বীপের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ডিজিটাল দ্বীপ প্রকল্পটি’র লক্ষ্য হল সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বিদ্যমান জনসুবিধাদির আরো প্রসার ঘটিয়ে মহেশখালীর বাসিন্দাদের জন্য সুযোগ তৈরি করা।
গত ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর এই দ্বীপে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড ফেস্ট’ আয়োজন করে আইওএম। এতে স্থানীয় শিক্ষার্থী ও বাসিন্দারা নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশনার এবং ভিডিও-অনলাইনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে ‘ডিজিটাল দ্বীপ’-কে তুলে ধরে।
মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জামিরুল ইসলাম বলেন, ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড একটি বহুমুখী প্রকল্প যা বাংলাদেশের অন্যতম বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীটিকে দেশের দ্রুততম গতির ইন্টারনেট মাধ্যমে বিশ্বের সাথে যুক্ত করেছে।’
তিনি আরো বলেন, দ্রুততর ইন্টারনেট সুবিধা স্থানীয় জনগোষ্ঠীটিকে উন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের পরিষেবাগুলো নিশ্চিতে ভূমিকা রাখছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দ্বীপটির বাসিন্দাদের শিক্ষা’র সরঞ্জামাদি এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য অনলাইন স্বাস্থ্য পরিষেবাও দেওয়া হয়। স্থানীয় শুটকি উৎপাদনকারীদের উৎপাদিত শুটকি বিক্রয়ের জন্য ই-কমার্সের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) পূরণে ডিজিটাল আইল্যান্ড দ্বীপ উদ্যোগও বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি অংশ।