আহমদ গিয়াস :
যে এলাকায় দাঁতরাঙা বা লুটকি গাছ জন্মে, সেখানে চা-পাতা গাছের চাষ ভাল হয়। দাঁতরাঙা গাছকে কক্সবাজার অঞ্চলের ভাষায় পুট্টি গাছ বলা হয়। মূলত এটি একটি সূচক বৃক্ষ। আর কক্সবাজার জেলাব্যাপী, বিশেষ করে পাহাড়ী অঞ্চলে এ গাছের ছড়াছড়ি বলে দেয় এখানে চা-পাতা চাষের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।
চা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল ও রফতানি পণ্য। দেশে বর্তমানে চায়ের বাজার রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার। দেশে প্রতি একর জমিতে এখন চায়ের উৎপাদন হচ্ছে জমিভেদে প্রায় এক হাজার কেজি থেকে ৪ হাজার কেজি পর্যন্ত। প্রতিকেজি চায়ের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩শ টাকা করে ধরলে একর প্রতি চা উৎপাদন হয় ৩ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকার। একসময় রামুর রাবার বাগান এলাকা ও চকরিয়ার ডুলাহাজারায় চা-বাগান থাকলেও এখন কক্সবাজারের কোথাও চায়ের চাষ হয় না। তবে কক্সবাজারেও চা-পাতা চাষের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে এবং এর মাধ্যমে এ এলাকার হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য বদলে দেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা।
বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও লেখক ড. গ্রীণ মিজানুর রহমান বলেন, চা-পাতা গাছ বা ক্যামেলিয়া সিনেনসিস হল একটি ভেষজ উদ্ভিদ। শরীর চাঙ্গা করার পানীয় হিসাবে চা এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। আর এই চা পাতা গাছ যেখানে ভাল জন্মে, সেখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো দাঁতরাঙা গাছ দেখা যায়। দাঁতরাঙা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম মেলাস্টোমা মালাবার্থিকাম (গবষধংঃড়সধ সধষধনধঃযৎরপঁস)। এ গাছের অর্থনৈতিক ও ভেষজ গুরুত্ব সীমিত হলেও এটি সূচক বৃক্ষ হিসাবে পরিচিত। আর কক্সবাজার জেলাব্যাপী, বিশেষ করে পাহাড়ী অঞ্চলে এ সূচক বৃক্ষের ছড়াছড়ি বলে দেয় এখানে চা-পাতা চাষ ভাল হবে।
একই কথা জানান, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিটিআরআই) পরিচালক ও কক্সবাজারের সন্তান ড. মোহাম্মদ আলী।
তিনি বলেন, চায়ের চাষ সম্প্রসারণের জন্য ২০০৪ সালে সারাদেশে চা-আবাদের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাঁকুরগাও, নীলফামারি, দিনাজপুর, লালমণিরহাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর নেত্রকোণা, টাংগাইলের মধুপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং কক্সাবাজার জেলায় মোট ১ লাখ ১ হাজার ৭২ হেক্টর স্বল্প আয়তনের জমি চিহ্নিত করা হয়। যারমধ্যে কক্সবাজার জেলার ২ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিও রয়েছে।
তবে অজ্ঞাত কারণে কক্সবাজারে এখনও চা পাতার চাষ শুরু হয়নি। কক্সবাজারের কোথাও এখন চায়ের চাষ না হলেও একসময় চায়ের বাগান থাকায় রামুর রাবার বাগান ও চকরিয়ার ডুলাহাজারার মালুমঘাট স্টেশন এখনও ‘চা-বাগান’ স্টেশন নামেই লোকমুখে বেশি পরিচিত। আর নতুন করে এখানে চায়ের বাগান গড়ে তুলে হারানো ঐতিহ্যও ফিরিয়ে আনা যায় বলে মনে করেন কক্সবাজারের গবেষক-ঐতিহাসিক মুহম্মদ নুরুল ইসলাম।
বিশিষ্ট বনবিদ, চট্টগ্র্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বনবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে চায়ের বাগান গড়ে তোলা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে ভ‚মিকা রাখার পাশাপাশি কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পেও নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।
চা বোর্ডের হিসাব মতে, দেশে চা চাষের জমির রয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর। যার মধ্যে বর্তমানে চাষ হচ্ছে ৫২ হাজার ৩১৭ হেক্টর জমিতে। বিশ্বে চা উৎপাদনের দিক থেকে এগিয়ে আছে চীন, ভারত, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কা। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। বর্তমানে দেশে মোট ১৬৭টি চা-বাগান রয়েছে, যার অধিকাংশই মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। এখানে রয়েছে ৯৩টি। এছাড়া হবিগঞ্জে রয়েছে ২২টি, সিলেট জেলায় ২০টি, চট্টগ্রামে ২৩টি, রাঙামাটিতে ১টি, পঞ্চগড়ে ৭টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১টি চা বাগান রয়েছে। এসব চা বাগানের মধ্যে ২০টি ব্রিটিশদের, ১৬টি সরকার পরিচালিত এবং বাকী ১৩১টি বাগানের মালিক দেশীয় নাগরিকরা। আর এসব চা বাগানে স্থায়ীভাবে প্রায় ৯০ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে, যার মধ্যে ৭৫ শতাংশই নারী শ্রমিক। দেশে ১১৪টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে।
চা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে (২০১৯-২০ সালে) দেশের চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হল ৮ কোটি কেজি। আর গত ৬ মাসের (জুলাই’১৯ থেকে ডিসেম্বর’১৯ পর্যন্ত) টার্গেট ছিল ৫ কোটি ৫০ লাখ কেজি, যেখানে প্রায় ৬ কোটি ৬৭ লক্ষ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে।
চা বোর্ডের হিসাবে, ২০১৭ সালে দেশে ৮ কোটি ৫৯ লাখ কেজি চা ভোগ হয়েছে, আর ২০১৯ সালে ৯ কোটি ৬৫ লক্ষ ১৭ হাজার ২৪০ কেজি। উৎপাদন ছিল তার চেয়ে কম। দেশে চায়ের চাহিদা ৬% হারে বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে বিবেচনায় নিলে ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে চায়ের চাহিদা দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৪ লাখ ৩০ হাজার কেজি। আর চলতি ২০২০ সালের চাহিদা রয়েছে ১০ কোটি ২৩ লাখ ৮ হাজার ২৭৪ কেজির।

অপর দিকে, ২০১৬ সালে দেশে ১ কোটি ৪৩ লাখ কেজি চা-পাতা আমদানি করতে হয়। ২০১৫ সালে তা ছিল ১ কোটি ৫০ লাখ কেজি এবং ২০১৪ সালে প্রায় ৬১ লাখ কেজি। ২০১৬ সালে সারা দেশে ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে, যা গত ২০১৫ সালের চেয়ে ১ কোটি ৭৮ লাখ ১০ হাজার কেজি বেশি।
২০১৩ সালে দেশে চা উৎপাদিত হয় ৬ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার কেজি, ২০১২ সালে ৬ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার কেজি, ২০১০ সালে ৬ কোটি ৪ লাখ কেজি, ২০০৯ সালে ৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার কেজি, ২০০৮ সালে ৫ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার কেজি, ২০০৭ সালে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার কেজি, ২০০৬ সালে ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার কেজি এবং ২০০৫ সালে ৬ কোটি ১ লাখ ৪০ হাজার কেজি। এই অবস্থায় চা শিল্প উন্নয়নে ‘উন্নয়নের পথ নকশা’ শীর্ষক একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬৭ কোটি টাকা ৩৫ লাখ টাকা। এ পরিকল্পনায় চায়ের অতীত ইতিহাস ধরে রাখতে ও গড় ব্যবহার বাড়াতে সারা দেশের চা বাগান থেকে ১১ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ চা বোর্ডের সচিব ক‚ল প্রদীপ চাকমা।
তিনি জানান, বিদ্যমান চা-বাগানগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ইতোমধ্যে বৃহত্তর পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর এবং নীলফামারী জেলার ৫০০ (পাঁচশত) হেক্টর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় ঠাকুরগাও-এ ৫০ হাজার, নীলফামারীতে ৫০ হাজার, দিনাজপুরে ৫০ হাজার এবং পঞ্চগড়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার চা চারার কাটিং লাগানো হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই ৫০০ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১২ লক্ষ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হবে। আগামী ২-৩ বছরের মধ্যেই এসব বাগান থেকে চা উৎপাদিত হবে। এছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা, উত্তর চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলায় চা চাষ প্রকল্প গ্রহণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে ফেব্রæয়ারি-মার্চের মাসের মধ্যে একটি স্টাডি রিপোর্ট তৈরি করা হবে বলেও জানান তিনি।
তবে কক্সবাজার এলাকায় সরকারী উদ্যোগে চা-চাষ সম্প্রসারণের জন্য সরকারের আপাতত কোন পরিকল্পনা নেই জানিয়ে চা বোর্ড সচিব বলেন- কক্সবাজারে কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে চা-বাগান করতে চাইলে তাকে চা-বোর্ডের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। বেসরকারিভাবে চ্ াচাষকে উৎসাহিত করার জন্য সরকার মাত্র ৩০ পয়সা দরে চারা দিচ্ছে। আবার সেই চারার রোপন খরচও উল্টো চাষীকে প্রদান করা হচ্ছে। অথচ ব্যক্তিগত নার্সারীতে একটি চা-পাতা গাছের চারা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা দরে।
সারা বিশ্বে গুণগত প্রকারভেদে চায়ের বিভিন্ন মূল্য রয়েছে। চীন ও ভারতের দার্জিলিং এর পাহাড় চ‚ড়ায় উৎপাদিত প্রতি কেজি ‘গ্রীণ টি’র দাম প্রায় ৭ হাজার ডলার। এই ধরনের চা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সুউচ্চ পাহাড়গুলোর চ‚ড়ায় চাষ করা যেতে পারে বলে জানান চা বোর্ড সচিব কুল প্রদীপ চাকমা।
একসময় চা রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানেও ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দেশে ও বিদেশে চায়ের চাহিদা বাড়লেও তার সাথে তাল মিলিয়ে উৎপাদন বাড়ানো যায়নি বলে এখন উল্টো বিদেশ থেকে চা আমদানী করতে হয় মাঝেমধ্যে। তবে চলতি বছর দেশে চায়ের উৎপাদন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলে জানায় বাংলাদেশ চা বোর্ড।
দেশে সর্ব প্রথম চা বাগান করার উদ্যোগ নেয়া হয় ১৮২৮ সালে। অবিভক্ত ভারতের চট্টগ্রামের কোদালায় (রাঙ্গুনীয়া) জমি নেয়া হয় চা বাগান স্থাপনের। বর্তমানে যেখানে চট্টগ্রাম ক্লাব, ১৮৪০ সালে সেখানেই পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করা হয় প্রথম চা গাছ। ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনিছড়া চা বাগানের মাধ্যমে চা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে প্রথম বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয়।