মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

গাইড বই নিষিদ্ধ। তবুও কোন প্রকাশনী ও লাইব্রেরি থেমে নেই। প্রশাসন বেশ কঠোর। গাইড বইসহ কোন লাইব্রেরী বা স্কুলে কেহ ধরা পড়লে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ন্যাশনাল কারিকুলাম টেক্সট বোর্ড (এনসিটিবি) বর্হিভুত ৪/৫ গুন বেশী দামে বই বিক্রি প্রায় ৯০% ভাগ সম্পন্ন করেছে কক্সবাজার জেলার বাণিজ্যিক লাইব্রেরি গুলো। তাই এবার শুরু করেছে অপ্রয়োজনীয় নিষিদ্ধ গাইড বই বিক্রি। প্রশাসন ও আইনকে তোয়াক্কা করছেনা কেউ। মাঠে নেমেছে দালালচক্র। ওরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুষ প্রদান বাবদ ১ কোটি টাকার উপরে বাজেট করেছে বলে জানা গেছে। দালালচক্র কেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কমিটির সভাপতিকে ঘুষ দেয় ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা অনুসারে। সহায়ক বইয়ের নামে ডজন খানেক পাবলিকেশন কোটি টাকার নিষিদ্ধ নোট গাইড কেজি স্কুল গুলোতে বিক্রির টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে।

সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে নোট গাইড শিক্ষার্থীদের ধরাতে শিক্ষকদের ম্যানেজ করতে কোটি টাকা ছড়ানো হচ্ছে বলে তথ্য মিলেছে। সূত্রমতে, কক্সবাজার জেলায় কেজি স্কুল প্রতি ৩০ হাজার টাকা থেকে সোয়া লক্ষ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিচ্ছে পাবলিকেশনস গুলো।

গত ডিসেম্বর থেকে পাবলিকেশনের অর্ধ্ব শতাধিক মার্কেটিং প্রতিনিধি কেজি স্কুল গুলোর প্রধান শিক্ষক, সিনিয়র সহকারী শিক্ষক, সভাপতির কাছে দৌড়ঝাঁপ করছেন। নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে মোটা অংকের টাকার ছড়াছড়ি। কক্সবাজার জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় টাকা নিয়ে ছুটছেন নিষিদ্ধ গাইড সরবরাহকারী পাবলিকেশনস গুলোর এসব অসাধু প্রতিনিধি।

অর্থ হাতিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের গাইড কিনতে পরামর্শ দিচ্ছেন কেজি স্কুল গুলোর শিক্ষক ও শিক্ষক নেতারা। কক্সবাজার জেলা শিক্ষা অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিজিট করতে গেলে কোন গাইড চোখে পড়েনা। আমরা যখন কোন ছাত্র ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করি পাঠ্যপুস্তকের সাথে আর কোন ধরনের বই পড়ানো হয় কিনা। তারা তোতা পাখির মতো শিখিয়ে দেওয়া শব্দটি বলে ‘না’। আমরা প্রকাশ্যে কোন কিছু দেখিনা।

তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত গাইড বই পড়ানো সম্পূর্ণ নিষেধ। গাইড বই বিক্রি, মজুদ বা বিতরণকালে কোন লাইব্রেরী বা স্কুলের কেও ধরা পড়লে ভ্রাম্যমাণ আদালতের আইন অনুসারে তাদের সাজা প্রদান করা হবে।

একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৮ সাল থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দু’একটি বিষয় ছাড়া বেশির ভাগ বিষয় সৃজনশীল পদ্ধতির আওতায় আনা হয়। শিক্ষার্থীদের মুখস্ত বিদ্যা পরিহার, গাইড বই ও কোচিং নির্ভরতা কমানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলন করে। কিন্তু সরকারের এই প্রয়াস ভেস্তে দেয়ার চেষ্টা করছে চিহ্নিত সব প্রকাশনী ও তাদের সহযোগী শিক্ষকেরা।

বিষয়টি নিয়ে নজরদারিতে মাঠে নেমেছে জেলা প্রশাসন ও জেলা শিক্ষা অফিস। তবে কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন তা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল সূত্র ও বই ব্যবসায়ীদের সূত্র সিবিএন-কে জানিয়েছে, মূলত নোট গাইড চালাতে বার্ষিক পরীক্ষার পরপরই চিহ্নিত প্রকাশনা কোম্পানির কর্মী বাহিনী মাঠে নেমে পড়েন। কেজি স্কুল ছাড়াও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিভিন্ন লাইব্রেরিতেও মোটা অংকের কমিশন ও উপঢৌকন দিয়ে গাইড চালাচ্ছে।

আর তা বিক্রি নিশ্চিত করতে এবার কোটি টাকা ছড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে টাকা ছড়ানোও শুরু হয়েছে। চিহ্নিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জেলায় কেজি স্কুল ফোরামের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, প্রধান শিক্ষক এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা পর্যায়ে ম্যানেজ ও দেনদরবার চালাচ্ছে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ কেজি স্কুল ও মাধ্যমিক স্তরের স্কুলে পৌঁছে গেছে পাবলিকেশনের লোকজন। গাইড পড়তে বা কিনতে উৎসাহিত না করতে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জেলা শিক্ষা আফিসের কর্মকর্তাদের সামনে তারা প্রতিশ্রুতি দিলেও চিহ্নিতরা তা ভুলে গিয়ে গাইড চালাতে তৎপরতা ছালিয়ে যাচ্ছেন।

সূত্র জানিয়েছে, পুঁথিনিলয়ের অনুপম প্রকাশনী, পপি পাবলিকেশন, লেকচার পাবলিকেশন, গ্যালাক্সি, নিউটন পাবলিকেশন, স্কয়ার, আশার আলো পাবলিকেশন, পুঁথিঘর পাবলিকেশনের সংসদ, ফুলকুড়ি পাবলিকেশন, গ্যালাক্সি পাবলিকশনসহ কমপক্ষে ডজন খানেক পাবলিকেশনস মাঠে টাকা ছড়ানোর প্রতিযেগিতায় নেমেছে।

এর মধ্যে অনুপম প্রকাশনী ৩০টির মতো কেজি স্কুলে টাকা সরবরাহ করেছে। স্কুলের ছাত্র অনুসারে ৩০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিচ্ছে এই প্রকাশনী। শহরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গাইড ধরাতে এক লাখ ২০ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়েছে বলে সুত্রটি জানিয়েছে।

আশার আলো পাবলিকেশনস কেজি স্কুল গুলোর প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গাইড ছাপিয়ে বাজারজাত করছে। কক্সবাজারে মাঠ চষছে তাদের ৪জন কর্মী। একইভাবে প্রত্যেক পাবলিকেশনস জেলার প্রতিটি উপজেলায় লোক লাগিয়ে শিক্ষক ও স্কুল ধরতে ব্যস্ত। কেজি স্কুলের ভর্তি হওয়া ছাত্র গুনে প্রধান শিক্ষকের হাতে মাথা প্রতি ১১০ টাকা ও মাধ্যমিকে ছাত্র মাথা প্রতি প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিকে ১৭০ টাকা করে দেয়ার চুক্তি হচ্ছে বলে তথ্য এসেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, কেজি স্কুল প্রতি ২০ হাজার টাকা থেকে সোয়া লক্ষ টাকা ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতি এক লাখ থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিচ্ছে পাবলিকেশনস গুলো। এতে কেজি স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষকেরা আর্থিক লাভবান হলেও মেধাশূন্য হতে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। গাইডের মান যাই হোক না কেন, তা যে কোনো উপায়ে চালাতে ওই টাকা আগাম নিয়েছেন তারা।

স্থানীয় সূত্রের দাবি, পাবলিকেশনের প্রতিনিধিরা নমুনা গাইড নিয়ে বিভিন্ন কেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চেয়ারের পাশে বসে খোশগল্প করছেন এমন চিত্র চোখে পড়ছে প্রায়ই। তারা জানিয়েছেন, গাইডের দাম খরচের চেয়ে ৫/৬ গুন বাড়িয়ে পাবলিকেশনগুলো উৎকোচ দেয়া টাকা তুলে নিচ্ছে। কয়েকটি কোম্পানির গাইড ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও জিম্মি দশায় পড়ে সন্তানের পড়ালেখার কথা চিন্তা করে কষ্ট হলেও কিনতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা।

অভিভাবকদের অভিযোগ, শিক্ষাব্যবস্থা সৃজনশীল হলেও শিক্ষা বিভাগের লোকবল সল্পতার কারণে কক্সবাজারের বাণিজ্যিক লাইব্রেরি গুলো গাইডে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা বছর শুরুর প্রথম থেকেই বাজারে ছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনীর চড়া মূল্যের কথিত এ গাইড শিক্ষার্থীদের কিনতে পরামর্শ দিচ্ছেন শিক্ষকরা।

কক্সবাজার জেলা শহর ও শহরতলীর কয়েকটি কেজি স্কুলের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বছরের শুরুতেই প্রকাশনীর লোকজন স্কুলে স্কুলে যাচ্ছেন। স্যারদের হাতে নমুনা বই দিচ্ছেন। প্রথম শ্রেণি থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে গাইড কিনতে নির্দেশনা দেন শিক্ষকরা।

কয়েকজন অভিভাবকের অভিযোগ, পাবলিশার্স থেকে উৎকোচের টাকা পেয়ে গাইড কিনতে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন স্কুলের শিক্ষকরা। সরকার শিশু শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বই দিলেও শিক্ষকরা তা পড়ান না। আর তারা শিশু শিক্ষার্থীদের গাইড কিনতে বলেন। একসেট গাইডের দামও তাদের মত গরীব অভিভাবকদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। গাইড কেনার কারণে এনসিটিবির বইয়ের গুরুত্ব কমছে।

কোনো সহায়ক গাইড বা সহায়ক বই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো শিক্ষক গাইড বিক্রেতা বা প্রকাশনীর সাথে সখ্যতা গড়লে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা রয়েছে। পাঠ্য পুস্তকই হোক একমাত্র সহায়ক এ শ্লোগানকে সামনে রেখে তিনি শিক্ষক অভিভাবক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের পথ চলার আহবান জানান।