দিলসাদ আনজুমান রুমা 

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর প্রাথমিক শিক্ষা হলো সকল শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। তাই গুণগত ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সকলের আন্তরিক প্রচেষ্ঠার প্রয়োজন। একথা সত্য যে, সীমিত সম্পদ ও অধিক জনসংখ্যার একটি দেশে গুণগত ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভবকে সম্ভব করার মত একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। তাই নিজের কর্ম-অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে মানসম্মত এবং গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে কিছু সুপারিশ তুলে ধরছি ।

১. শিশুদের শিখন-শেখানোর পরিবেশকে আনন্দ-মুখর ও শিশু-বান্ধব করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। শ্রেণিকক্ষে রঙিন কাগজে চারু ও কারুকলার কাজ সুন্দরভাবে টানিয়ে স্বল্পব্যয়ে শিশু-শিক্ষার্থীদের কাছে শ্রেণিকক্ষকে চিত্তাকর্ষক ও গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলা যেতে পারে।

২. এ কথা সত্য যে, প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু শুধু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেই চলবে না, প্রশিক্ষণ থেকে অর্জিত জ্ঞান শ্রেণি পাঠদানে শিক্ষক কর্তৃক যথাযথভাবে প্রয়োগ এবং প্রযোজ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রয়োজনীয় ফলোআপ নিশ্চিত করতে হবে। একজন শিক্ষক নিজে অবশ্যই শ্রবণযোগ্য স্বরে প্রমিত বাংলায় বন্ধুসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিতে কথা বলবেন, মৌখিক ও অমৌখিক ভাব বিনিময়ে ইতিবাচকতার ছাপ থাকবে। শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের সম্পর্ক হবে পেশাগত, ইতিবাচক ও ন্যায়সঙ্গত।

৩. একজন শিক্ষককে অবশ্যই বার্ষিক ও দৈনিক পাঠ-পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সে আলোকে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং হাসিমুখে তার উত্তর দিতে হবে।শিক্ষার্থীদেরকে বেশি বেশি উন্মুক্ত প্রশ্ন করতে হবে যাতে তারা নিজের ভাষায় নিজের মত করে মনের ভাব প্রকাশের সুযোগ পায়।

৪. শিক্ষক কখনোই ভুলে যাবেন না যে, শ্রেণিতে সবল ও দুর্বল শিক্ষার্থী রয়েছে এবং সে অনুযায়ী তাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে যতটুকু সম্ভব ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে ইসিএল এবং ডিপিএড-এর আলোকে স্তর ভিত্তিক পাঠদান অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে।

৫. বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে যতটুকু সম্ভব বিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে এবং এ বিষয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির ভূমিকা কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

৬. ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ও টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) নিশ্চিতকরণে সমগ্র প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিটি কর্মসূচিকে তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক প্রক্রিয়ার আওতায় এনে তা মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।

৭. প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্রমান্বয়ে পাঠাগার, সীমিত পরিসরে বিজ্ঞান-গবেষণাগার এবং কম্পিউটার ল্যাব গড়ে তুলতে হবে। তার সাথে সাথে সরকার প্রদত্ত ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার এবং ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করে পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে। এ কনটেন্টগুলো অবশ্যই দৃষ্টিনন্দন ও শিশুদের চাহিদাসম্পন্ন হতে হবে। তবে শুধুমাত্র মাল্টিমিডিয়ার উপর নির্ভরতা শ্রেণি পাঠদানে সহায়ক হবে না যদি শিক্ষক- শিক্ষার্থী মিথষ্ক্রিয়া এবং একক চিন্তন, জোড়ায় আলোচনা, দলীয় কাজ, হাতে কলমে শিক্ষাদান ও গ্রহণ এবং বাস্তব উপকরণ ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ পাঠদান না হয়।

৮. শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বিদ্যালয়ে গল্প বলা, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, উপস্থিত ও নির্ধারিত বক্তৃতা নিয়মিতভাবে পরিচালনা এবং বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উৎসবমুখর পরিবেশে আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে।

৯. আন্ত:প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট, জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতাসহ স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদেরকে উৎসাহিত করা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

১০. বিদ্যালয়ে অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া, শিক্ষক ও এসএমসি সদস্য কর্তৃক কার্যকর হোমভিজিট করা, মা সমাবেশ, উঠোন বৈঠক, শিক্ষক-অভিভাবক সভা ও অভিভাবক সমাবেশে আলোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা।

১১. বিদ্যালয়ে স্লিপার, দোলনা ও আউট-ডোর খেলাধুলার সামগ্রী বৃদ্ধি করা যাতে শিশুরা উন্মুক্ত পরিবেশে খোলামেলা ছুটোছুটির সুযোগ পায়। সাথে সাথে বিদ্যালয় আঙিনায় বনজ, ফলদ ও ভেষজ বৃক্ষ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ রঙিন ও সুগন্ধী ফুলের বাগান শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে অবস্থানের প্রতি উৎসাহিত করবে ।

১২. নিয়মিত শপথবাক্য পাঠ করানোসহ সমাবেশ ও সঠিক তাল, লয় ও সুরে জাতীয় সংগীত পরিচালনা ও কাবিং কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেম, নৈতিকতা, জাতীয়তাবোধ, চেতনা, নেতৃত্ব, চরিত্র গঠন, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় ইতিবাচক অগ্রগতি সাধন করবে।

১৩. সরকারি ও স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় সকল বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করতে হবে।

১৪. যেকোন এলাকায় সরকারিভাবে গৃহীত যেকোন বিদ্যালয় উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে উক্ত এলাকার জনসাধারণ ও জনপ্রতিনিধিদের স্কুলের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। যেমন- স্লিপ তহবিল গঠনের জন্য স্থানীয় জনগণকে উৎসাহিত করা, তহবিল সংগ্রহ ও বিদ্যালয়ে শিশুবান্ধব ও আনন্দদায়ক পাঠদান পরিবেশ তৈরীতে এ তহবিলের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।

১৫. এনজিও ও ব্যক্তি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান যে সকল এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের সকল কর্মসূচি অবশ্যই সরকার গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির সাথে সমন্বয় করতে হবে এবং পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে।

১৬. সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের বিভাগ বহির্ভূত কাজ থেকে বিরত রেখে শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পাঠদানের সুযোগ অবারিত করা। যতদূর সম্ভব শ্রেণিকক্ষ ও বিভাগ বহির্ভূত কাজে শিক্ষকদেরকে সংশ্লিষ্ট না করে নিজ নিজ দায়িত্বপালনে নিয়োজিত রাখা হলে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

১৭. সুস্থ-সবল এবং মেধাসম্পন্ন শিশু গড়ে তোলার লক্ষ্যে মা ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে এবং ভেজালমুক্ত খাদ্য সরবরাহ করার জন্য সরকারকে কার্যকর ও কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে খাদ্যে ভেজাল মেশালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখতে হবে।

১৮. স্থাপিত বিদ্যালয়সমূহের ভৌত পরিবেশ উন্নত করে তাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষার্থীর বসার ব্যবস্থা ও যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, আকর্ষণীয়-আনন্দদায়ক-শিশুবান্ধব পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন, দরিদ্র শিশুদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে বিনামূল্যে স্কুলের পোশাক ও টিফিন সরবরাহ করা।

 

লেখক : প্রধান শিক্ষক, বড় ভেওলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। (২০১৯ সালে চকরিয়া উপজেলায় নির্বাচিত প্রধান শিক্ষক)