মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

সাগরের মাছধরার ট্রলারের জেলেদের, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদকে হিংস্র কুমিরের ভয়াবহ গ্রাস থেকে মুক্ত করে তাদের ডাঙ্গায় তোলার বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছি। জলদস্যু, অস্ত্রের কারিগর, সশস্ত্র অবৈধ অস্ত্রধারী নামক ভয়ংকর সন্ত্রাসী কুমির গুলোকে ডাঙ্গায় এনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে না আসা পর্যন্ত আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তীব্র অভিযান অব্যাহত থাকবে।

গত ২৩ নভেম্বর কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছরা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় মাঠে ৯৬ জন জলদস্যু, অস্ত্র তৈরীর শীর্ষ কারিগর, পলাতক আসামী ও ভয়ংকর উপকূলীয় সন্ত্রাসী তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করার পর সিবিএন এর কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম এ কথা বলেন। এ আত্মসমর্পণকে কিভাবে দেখছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে এসপি এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম সিবিএন-কে বলেন-এটি একটি দুঃসাহসিক অভিযান, এ অভিযানে যারা রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি, তাদের এখনো সুযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করার। যদি আত্মসমর্পণ না করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান অভিযানকে আরো ক্ষিপ্র করে, গতিশীল ও পরিধি বাড়িয়ে সকলকে আইনের কঠোর আওতায় নিয়ে আসা হবে ইনশাল্লাহ। ২৩ নভেম্বরের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সফলতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি, এ প্রশ্নের উত্তরে এসপি মাসুদ হোসেন সিবিএন-কে বলেন, ২৩ নভেম্বর শনিবার ছিলো মহেশখালী সহ কক্সবাজারের পুরো সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার জন্য একটা বিশাল উৎসবের দিন। মহেশখালী উপজেলার কালারমারছরা ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে এ অনুষ্ঠান হলেও হাজার হাজার মানুষের সরব পদচারনায় পুরো এলাকা একটা উৎসবে পরিণত হয়েছিলো। অতিথিদের হেলিকপ্টার অবতরনে এরিয়া থেকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানস্থল পর্যন্ত শত শত তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। মানুষ এ আত্মসমর্পণকে কত বেশী গ্রহণ করেছে, তার একটা প্রমাণ হলো সকল মানুষের চোখে মুখে স্বস্তি ও আনন্দের উচ্ছাস। কারণ জলের এসব কুমিরের কাছে বছরের পর বছর জিম্মি ছিলো তারা। কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারতোনা। সে ভয়ংকর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কিছুটা হলেও অবসান হয়েছে বলে মনে করছি। তবে সফল কতটুকু হয়েছি তা মূল্যায়নের দায়িত্ব সেখানকার আমজনতার। মুক্তা উৎপাদনের দ্বীপ মহেশখালীর সাধারণ মানুষকে অপরাধ জগতের এসব লোকজনের ভয়ংকর জিম্মিদশা থেকে মুক্তি দিতে ২৩ নভেম্বরের বিশাল ও বর্ণাঢ্য আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। সৃষ্টি হয়েছে কক্সবাজার জেলা পুলিশের ইতিহাসে সাফল্যের এক নতুন অধ্যায়। যে অধ্যায় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছে। যেখানে রয়েছে শুধু অশান্ত মহেশখালী উপজেলা নয়, পুরো কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলকে শান্ত করার নতুন হাতছানি। যে মহেশখালীর কালারমারছরায় যাদের নাম ভয়ে উচ্চারণ করা যেতোনা, ২৩ নভেম্বর শনিবার সেরকম হাজার হাজার সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হওয়ায় তারা বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছে। এখানকার মানুষের অন্যান্য সময়ের আতংকিত মুখগুলো সমাবেশের সময় যেন পূর্ণিমার চাঁদের মতোই জ্বল জ্বল করছিলো। তারা পূর্বে কখনো বিশ্বাসই করতে চায়নি, মানুষখেকো গভীর জলের হিংস্র কুমির গুলোকে ডাঙ্গায় আনা যাবে। কিন্তু কক্সবাজার জেলা পুলিশ সততা, দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও পেশাদারিত্ব দিয়ে সে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। যেটা ছিলো অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য, কল্পিত বিষয়। শুধু তাই নয়, মহেশখালীতে বাস্তবায়নাধীন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলপিজি টার্মিনাল, গভীর সমুদ্র বন্দর, ধলঘাটা অর্থনৈতিক অঞ্চল সহ সরকারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কার্যক্রমে আরো গতি আসবে। বিনিয়োগে আগ্রহী হবে বিদেশীরা।
গত বছরের ২০ অক্টোবর ৪৩ জন ও ২৩ নভেম্বর ৯৬ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণের মাধ্যমে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল পুরোপুরি জলদস্যু মুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে এসপি এ.বিএম মাসুদ হোসেন বিপিএম সিবিএন-কে বলেন-কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলকে পুরোপুরি জলদস্যু মুক্ত করা এখনো সম্ভব হয়নি। সমুদ্রে, গভীর জঙ্গলে, পাহাড়ে, প্যারাবনে গত ২৪ নভেম্বরের আত্মসমর্পণের পর এখনো যেসব জলদস্যু রয়েছে, তারা অবিলম্বে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ না করলে, তাদেরকে আইনের ভয়াবহ পরিণতি উপভোগ করতে হবে। এ বিষয়ে ২৩ নভেম্বরের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের আইনশৃংখলা রক্ষার সর্বোচ্চস্থরের প্রধান মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপিও কঠোর হুশিয়ারী দিয়েছেন। এ হুশিয়ারিতে যারা সমুদ্র উপকূলে অপরাধ জগতে থেকে এখনো আত্মসমর্পণ করেনি তারা এবং তাদের নাটের গুরু গডফাদারেরা উদ্বিগ্ন ও আতংকিত হয়ে পড়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে, আইনের দীর্ঘ ও কঠিন হাত থেকে বাঁচতে চাইলে রাষ্ট্রের আহবানে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ পূর্বক স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গন্ত্যান্তর নেই। একইভাবে নিজেদের ভূল বুঝতে পেরে যারা ২৩ নভেম্বর আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেককে প্রাথমিকভাবে নগদ ৫০ হাজার টাকা করে তাৎক্ষণিক অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ভবিষ্যতে তাদের আরো আর্থিক সহায়তা সহ বিভিন্নভাবে পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করা হবে বলে রাষ্ট্রের পক্ষে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আত্মসমর্পণকারীদের পূর্বের হত্যা ও ধর্ষন মামলা ছাড়া অবশিষ্ট সকল মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে বলে সেদিনের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে থাকা অন্যান্য মামলাগুলোতেও রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনী সহায়তা দেওয়া হবে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের এ সাফল্যের পেছনে আপনার আর কাদের অবদান রয়েছে বলে মনে করেন, এ প্রশ্নের উত্তরে এসপি মাসুদ হোসেন বিপিএম সিবিএন-কে বলেন, দেশের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুরোধা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রধান আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) ও পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার) পিপিএম এর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, তাঁদের প্রদত্ত উৎসাহে কক্সবাজার জেলা পুলিশেকে এ সফলতা এনে দিয়েছে। দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যুগিয়েছেন সবসময় তাঁরা। কক্সবাজার জেলা পুলিশের প্রতিটি সদস্য যাঁরা নিরলসভাবে ঝুঁকি নিয়ে একাজ করেছেন তাঁরা। কক্সবাজার জেলা পুলিশের একদল দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন আত্মপ্রত্যয়ী কর্মকর্তা ও সদস্য। যাদের নিরন্তর সহযোগিতা ও দায়িত্বশীল ভুমিকা একাজের সফলতা এনে দিয়েছে কক্সবাজার জেলা পুলিশকে। যাদের কাজের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন, আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি, কক্সবাজারের সন্তান এম.এম আকরাম হোসাইন। তাঁর সাহসী ভূমিকাও ছিলো অনস্বীকার্য।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের সমৃদ্ধ ইতিহাস সৃষ্টির নায়ক কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম এর কাছে আত্মসমর্পণের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি সিবিএন-কে মহান আল্লাহতায়লার কাছে অশেষ শোকরিয়া জ্ঞাপন করে এজন্য কক্সবাজার জেলা পুলিশের সকল সদস্য, মহেশখালী উপজেলা প্রশাসন, কালারমারছরা ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ, গণমাধ্যম সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান। তিনি কক্সবাজার জেলা পুলিশের ভবিষ্যতের সকল কর্মকান্ডে সকলের গঠনমূলক সহযোগিতা কামনা করেন।