মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

সারেন্ডার করার জন্য মধ্যস্থতাকারীর সেভহোমে থাকা ৯৫ জন জলদস্যু, অস্ত্র তৈরীর কারিগর ও দাগী পলাতক আসামীকে কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে শনিবার ২৩ নভেম্বর সকাল পৌনে ৭ টার দিকে মধ্যস্থতাকারী আনন্দ টিভি’র চট্টগ্রাম ব্যুরো চীফ এম.এম আকরাম হোসাইন তাদের অফিসিয়ালি হস্তান্তর করেন। বিশ্বস্ত সুত্র সিবিএন-কে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হওয়া ৯৫ জন জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগরকে প্রিজন ভ্যানে করে কড়া পুলিশ প্রহরায় আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মহেশখালী উপজেলার কালারমারছরা ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে শনিবার ২৩ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি ও আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) সহ অন্যান্য অতিথিদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অবৈধ অস্ত্র, অস্ত্র তৈরীর সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ জমা জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করবেন। আত্মসমর্পণকারী ৯৫ জন জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগরের প্রতিজনকে ৫০ হাজার টাকা করে ৪৭ লক্ষ টাকা নগদ তাৎক্ষণিক দেয়া হবে। এরপরও আত্মসমর্পণকারীদের সরকারীভাবে পূণর্বাসন ও অন্যান্য প্রণোদনা দেওয়া হবে। আত্মসমর্পনকারীদের অস্ত্র আইনে মহেশখালী থানায় জিআর মামলা দায়ের করে আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে শনিবারেই কারাগারে প্রেরণ করা হবে।

আত্মসমর্পণের জন্য কালারমার ছরা ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে নিয়ে যাওয়া ৯৫ জনের মধ্যে ১২ জন অস্ত্র তৈরীর শীর্ষ কারিগর, ১৭ টি কুখ্যাত জলদস্যু বাহিনীর প্রধান সহ ৮৩ জন জলদস্যু রয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশ এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। সকাল ১১ টায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের বক্তৃতাপর্ব শুরু হবে। এরপর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করা হবে।

মহেশখালী উপজেলার কালারমারছরা ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করছে কালারমারছরা ইউনিয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্ট এলাকায়।

এই আত্মসমর্পণকারীর অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি, পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) যথাক্রমে প্রধান ও বিশেষ অতিথি হিসাবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে শনিবার ২৩ নভেম্বর সকাল ৯ টায় প্রথম ফ্লাইটে কক্সবাজার পৌঁছাবেন বলে সিবিএন-কে জানিয়েছেন এসপি এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম। অন্য একটি বিশ্বস্থ সুত্র মতে, র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও আইজিপি’র সাথে একই ফ্লাইটে আসতে পারেন। অতিথিরা বিমানবন্দর থেকে তাঁরা কিছুক্ষণের জন্য সার্কিট হাউসে অবস্থান করে জলদস্যু আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সামগ্রিক বিষয়াবলী জ্ঞাত হবেন। এরপর শনিবার সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে হেলিকপ্টারযোগে জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগর আত্মসমর্পণের জন্য নির্ধারিত মাঠ কালারমারছরা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন।

এসপি এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম আরো জানান, ভিভিআইপি, আমন্ত্রিত অতিথি সহ প্রায় এক হাজার মানুষ অনায়সে সেখানে বসার ব্যবস্থা হওয়ার মতো নান্দনিক ডিজাইনে বিশাল প্যান্ডেলটি নির্মাণ করা হয়েছে। আগত অতিথিদের নিরাপত্তা, অভ্যর্থনা, প্রটোকল, জলদস্যুদের জমায়েত, তাদের অস্ত্র জমা করা, যাতায়াত সুবিধা, পার্কিং, প্যান্ডেল, মঞ্চ তৈরি, নিরাপত্তা বেষ্টনী, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান ইত্যাদি সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে রেকি ও ম্যাপ মতো সবকিছু পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে ইনশাল্লাহ। তিনি বলেন, অন্ধকার জগতের অপরাধীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকার বেশ আন্তরিক ও উদার। প্রচলিত আইনে আত্মসমর্পণকারীদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ আইনী সহায়তা দেওয়া হবে। এসপি এ.বি.এম মাসুদ হোসেন সিবিএন-কে বলেন, রাষ্ট্রের প্রদত্ত আত্মসমর্পণের এই সুবর্ণ সুযোগ এলাকার যেসব অপরাধী গ্রহন করেনি, তাদের বিরুদ্ধে গহীম পাহাড়ে, উপকূলের প্যারাবনে, সমুদ্রে, কুতুবদিয়াতে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সাড়াষী অভিযান চালাবে। অপরাধী যেই হোক, কাউকেই আইনের হাত থেকে রেহায় দেওয়া হবেনা।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন সিবিএন-কে বলেন, মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, ধলঘাটা বিশেষ অর্থনৈতিক জোন ইত্যাদির কারণে মহেশখালী এখন দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এখানে কোন অবস্থাতেই কোন সন্ত্রাসী, অপরাধী, দাগী আসামি থাকতে দেওয়া হবেনা। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী চাকুনী দিয়ে চেকে চেকে সকল অপরাধীকে কঠোর আইনের আওতায় নিয়ে আসবে ইনশাল্লাহ।
আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে কূখ্যাত খউস্বর বর গ্রুপ, কালারবর গ্রুপ, জিয়া বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, আইয়ুব বাহিনী, জমির উদ্দিন বাহিনী, কামাল বাহিনী, সিরাজদৌল্লা বাহিনী আয়াতুল্লাহ বাহিনী সহ ১৭ টি পৃথক জলদস্যু বাহিনীর প্রধান, সদস্যরা, অস্ত্রের কারিগরদের সর্দার, দাগী পলাতক আসামী রয়েছে।
এসব কূখ্যাত বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসাবে পরিচিত কালারমারছরা সহ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন এসব বিষয়ে সাহসের সাথে এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। অশান্ত জনপদে শান্তি ফিরে আসবে বলে আশাবাদী হচ্ছেন, এলাকার সাধারণ মানুষ।

এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের একমাত্র মধ্যস্থতাকারী প্রাইভেট টিভি চ্যানেল আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি, কক্সবাজারের পেকুয়ার উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের মালেক পাড়ার বাসিন্দা এম.এম আকরাম হোসাইন সিবিএন-কে জানিয়েছেন, অস্ত্রের কারিগর, বহু মামলার পলাতক আসামী, দুধর্ষ সন্ত্রাসী ও জলদস্যুরা দেড় শতাধিক অবৈধ অস্ত্র, প্রায় ২ হাজারের বেশী গোলাবারুদ, ধারালো ভয়ংকর অস্ত্র, অস্ত্র তৈরীর সরঞ্জাম সহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে।
আনন্দ টিভি’র চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান এম.এম আকরাম হোসাইন সিবিএন-কে জানান, দেশের অন্যান্য এলাকার জলদস্যু এবং কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার জলদস্যুদের মধ্যে একটু ভিন্নতা রয়েছে। এখানকার জলদস্যুরা স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে অনেকটা জিম্মি। জলদস্যু নিজে ও স্বজনদের জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে জলদস্যুতা, অস্ত্র তৈরীর মতো জগণ্য পেশাকে অবলম্বন করে অন্ধকার জগতে রয়েছেন।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদিতে ও অনুষ্ঠানের সার্বিক কর্মকান্ড দেখভাল করতে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার) পিপিএম শুক্রবার ২২ নভেম্বর রাতেই কক্সবাজার এসেছেন।

এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কক্সবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, স্থানীয় অন্যান্য সংসদ সদস্যগণ, র‍্যাবের কর্মকর্তা, বিজিবি’র রিজিওন কমান্ডার, ডিজিএফআইয়ের প্রতিনিধি, কোস্টগার্ডের প্রতিনিধি, কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা সহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগ দেবেন বলে সিবিএন-কে বিশ্বস্ত সুত্র নিশ্চিত করেছেন। কক্সবাজার জেলা পুলিশ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম সভাপতিত্ব করবেন। এটি হবে মহেশখালীতে জলদস্যুদের ২য় দফায় আত্মসমর্পণ।

প্রসংগত, ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে অনুরূপভাবে ৪৩ জন সশস্ত্র জলদস্যু আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলো। সেখানে ৪৩ জনের মধ্যে বর্তমান আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি এম.এম আকরাম হোসাইনের একক মধ্যস্থতায় ৩৭ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছিলো। আত্মসমর্পণকারী মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়ার সমুদ্র উপকূলের ভয়ংকর জলদস্যুরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিকজীবনে ফিরে এসেছে। এছাড়া চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারী ১০২ জন ইয়াবাকারবারী টেকনাফে চ্যানেল ২৪ টিভি’র তৎকালীন সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার এম.এম আকরাম হোসাইনের একক মধ্যস্থতায় দেশে প্রথম মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করেছিলো। সেদিনের মাদক কারবারী আত্মসমর্পণ করা ছিলো এ দেশের জন্য একটা ইতিহাস ও রেকর্ড। এরমধ্যে গত বছরের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে আত্মসমর্পণ করা ৪৩ জন জলদস্যু সরকারের কাছ থেকে প্রতিজন এক লক্ষ টাকা করে আর্থিক অনুদান পেয়ে তারা কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এখন ক্ষুদ্র ব্যবসা বাণিজ্য করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।
বিশ্বস্ত সুত্র মতে, শনিবার ২৩ নভেম্বর আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত ৯৫ জন জগণ্য অপরাধীদের মধ্যে কূখ্যাত অস্ত্রের শীর্ষ কারিগর জাফর আলম সহ আরো ১২ জন অভিজ্ঞ ও দক্ষ অস্ত্রের কারিগর রয়েছে। অস্ত্র তৈরীর এসব কারিগরের আত্মসমর্পণও বাংলাদেশের জন্য সর্বপ্রথম। যা হবে এদেশের জন্য একটা ইতিহাস। বিশ্বস্ত সুত্র মতে, দেশে এর আগে আর কোনদিন অস্ত্র তৈরীর কারিগর রাষ্ট্রের কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেনি।