মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

কক্সবাজার জেলা পুলিশের ব্যবস্থাপনায় আগামী শনিবার ২৩ নভেম্বর মহেশখালী উপজেলার কালারমারছরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি প্রায় ৯০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ শুক্রবার সকালের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। মহেশখালী উপজেলার কালারমারছরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ পরিদর্শন করে এমনটি সিবিএন-কে জানিয়েছেন- কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন। তিনি বলেন, ভিভিআইপি, আমন্ত্রিত অতিথি সহ প্রায় এক হাজার মানুষ অনায়সে সেখানে বসার ব্যবস্থা হওয়ার মতো বিশাল প্যান্ডেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। আগত অতিথিদের নিরাপত্তা, অভ্যর্থনা, প্রটোকল, জলদস্যুদের জমায়েত, তাদের অস্ত্র জমা করা, যাতায়াত সুবিধা, পার্কিং, প্যান্ডেল, মঞ্চ তৈরি, নিরাপত্তা বেষ্টনী, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান ইত্যাদি সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে রেকি ও ম্যাপ মতো সবকিছু পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হচ্ছে ইনশাল্লাহ।

অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর বিকেল পর্যন্ত ৭৬ জন অস্ত্রের কারিগর, জলদস্যু ও সশস্ত্র সন্ত্রাসী, বহু মামলার পলাতক আসামী শনিবার ২৩ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে মধ্যস্থতাকারীর নিয়ন্ত্রণাধীন ‘সেভহোমে’ চলে এসেছে। আত্মসমর্পণের জন্য অপেক্ষায় থাকা এরকম আগ্রহীরা মধ্যস্থতাকারীদের নিয়ন্ত্রণে আসার জন্য এখনো যোগাযোগ করছে বলে এই আত্মসমর্পণের একমাত্র মধ্যস্থতাকারী প্রাইভেট টিভি চ্যানেল আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি, কক্সবাজারের পেকুয়ার উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের মালেক পাড়ার বাসিন্দা এম.এম আকরাম হোসাইন সিবিএন-কে জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক জলদস্যুদের অনুরোধে সেভহোমে আসতে শুক্রবার ২২ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত সময় বাড়ানোর ফলে বর্ধিত সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণকারীর সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বস্ত সুত্রমতে, অস্ত্রের কারিগর ও জলদস্যুরা দেড় শতাধিক অবৈধ অস্ত্র, প্রায় ২ হাজার গোলাবারুদ, ধারালো ভয়ংকর অস্ত্র, অস্ত্র তৈরীর সরঞ্জাম সহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবেন।

এই আত্মসমর্পণের একমাত্র মধ্যস্থতাকারী প্রাইভেট টিভি চ্যানেল আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি এম.এম আকরাম হোসাইন সিবিএন-কে জানান, দেশের অন্যান্য এলাকার জলদস্যু এবং কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার জলদস্যুদের মধ্যে একটু ভিন্নতা রয়েছে। এখানকার জলদস্যুরা স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে অনেকটা জিম্মি। জলদস্যু নিজে ও স্বজনদের জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে জলদস্যুতা, অস্ত্র তৈরীর মতো জগণ্য পেশাকে অবলম্বন করে অন্ধকার জগতে রয়েছেন। তাঁর মতে, এখানকার জলদস্যুরা অনেকটা বন্দী খাঁচায় মৃত পাখীর মতো।

কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার জলদস্যু, অস্ত্রের কারিগর সহ দাগী অপরাধীদের আত্মসমর্পণ সম্পর্কে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার) পিপিএম সিবিএন-কে জানান, অন্ধকার জগতের অপরাধীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকার বেশ আন্তরিক ও উদার। প্রচলিত আইনে আত্মসমর্পণকারীদের সর্বোচ্চ আইনী সহায়তা দেওয়া হবে উল্লেখ করে ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার) পিপিএম সিবিএন-কে আরো বলেন-আত্মসমর্পনকারীদের সরকারের পক্ষ থেকে পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদিতে ও অনুষ্ঠানের সার্বিক কর্মকান্ড দেখভাল করতে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার) পিপিএম শুক্রবার ২২ নভেম্বর কক্সবাজার পৌঁছাবেন বলে বিশ্বস্থ সুত্র সিবিএন-কে জানিয়েছেন।

এদিকে, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর মহেশখালী উপজেলার কালারমারছরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সার্বিক প্রস্তুতি দেখতে কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) নিহাদ আদনান তাইয়ান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোঃ আদিবুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (চকরিয়া সার্কেল) কাজি মতিউল ইসলাম, কক্সবাজার কমিউনিটি পুলিশিং এর সভাপতি ও দৈনিক কালের কন্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি তোফায়েল আহমেদ, চ্যানেল আই এর সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার সরওয়ার আজম মানিক, মহেশখালীর ওসি প্রভাষ চন্দ্র ধর প্রমুখ মাঠ পরিদর্শন করেন।

এই আত্মসমর্পণকারীর অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি, পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) যথাক্রমে প্রধান ও বিশেষ অতিথি হিসাবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে শনিবার ২৩ নভেম্বর সকাল ৯ টায় প্রথম ফ্লাইটে কক্সবাজার পৌঁছাবেন। সেখান থেকে তাঁরা কিছুক্ষণের জন্য সার্কিট হাউসে অবস্থান করে জলদস্যু আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সামগ্রিক বিষয়াবলী জ্ঞাত হবেন। এরপর শনিবার সকাল সোয়া ১০ টার দিকে সমুদ্র পথে স্পীডবোট যোগে জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগর আত্মসমর্পণের জন্য নির্ধারিত মাঠ কালারমারছরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন।

কক্সবাজার জেলার সবচেয়ে বেশী অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসাবে পরিচিত এই মহেশখালী উপজেলার কালামারছরা ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা। খুন, রাহাজানি, দস্যূতা, অপহরণ, চাঁদাবাজি সহ সব জগন্য অপরাধকর্ম সংগঠিত হওয়া কালারমারছরার জন্য একেবারে নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। মহেশখালীর চিহ্নিত অস্ত্রের কারিগর ও কূখ্যাত বেশ ক’টি জলদস্যু বাহিনীর সর্দার ও বাহিনীর সদস্যরা এদিন স্বদলবলে আত্মসমর্পণ করছেন। আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে কূখ্যাত খউস্বর বর গ্রুপ, কালারবর গ্রুপ, আইয়ুব বাহিনী সহ ৮ টি পৃথক জলদস্যু বাহিনীর প্রধান, সদস্যরা, অস্ত্রের কারিগরদের সর্দার, দাগী পলাতক আসামীরা আত্মসমর্পণ করতে মধ্যস্থতাকারীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এসব কূখ্যাত বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসাবে পরিচিত কালারমারছরা সহ উপকূলীয় এলাকায় সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন এসব বিষয়ে সাহসের সাথে এখন মুখ খুলতে চেষ্টা করছেন।

এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কক্সবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, স্থানীয় অন্যান্য সংসদ সদস্যগণ, র‍্যাবের কর্মকর্তা, বিজিবি’র রিজিওন কমান্ডার, কোস্টগার্ডের প্রতিনিধি, মহেশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরীফ বাদশা, কালারমারছরার ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফ সহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগ দেবেন বলে সিবিএন-কে বিশ্বস্ত সুত্র নিশ্চিত করেছেন। কক্সবাজার জেলা পুলিশ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম সভাপতিত্ব করবেন।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সফল করতে, জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগরদের তাদের আস্তনা থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনতে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যস্থতাকারী আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি এম.এম আকরাম হোসাইন বিরাট ঝুঁকি নিয়ে এখনো দিনরাত মহেশখালী উপকূল ও সাগরে অবস্থান করছেন।

এটি হবে মহেশখালীতে জলদস্যুদের ২য় দফায় আত্মসমর্পণ। এর আগে আত্মসমর্পণকারী মহেশখালী-কুতুবদিয়া সমুদ্র উপকূলের ভয়ংকর জলদস্যুরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিকজীবনে ফিরে এসেছে।

প্রসংগত, ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে অনুরূপভাবে ৪৩ জন সশস্ত্র জলদস্যু আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলো। সেখানে ৪৩ জনের মধ্যে বর্তমান আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি এম.এম আকরাম হোসাইনের একক মধ্যস্থতায় ৩৭ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছিলো। আত্মসমর্পণকারী মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়ার সমুদ্র উপকূলের ভয়ংকর জলদস্যুরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিকজীবনে ফিরে এসেছে। এছাড়া চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারী ১০২ জন ইয়াবাকারবারী টেকনাফে চ্যানেল ২৪ টিভি’র তৎকালীন সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার এম.এম আকরাম হোসাইনের একক মধ্যস্থতায় দেশে প্রথম মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করেছিলো। সেদিনের মাদক কারবারী আত্মসমর্পণ করা ছিলো এ দেশের জন্য একটা ইতিহাস ও রেকর্ড। একটি সুত্র সিবিএন-কে জানান, জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের এটা একটা বিরাট সুযোগ। যারা এই সুযোগ কাজে লাগাবে না তাদেরকে কঠোর আইনের আওতায় আনা হবে। এরমধ্যে গত বছরের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে আত্মসমর্পণ করা ৪৩ জন জলদস্যু সরকারের কাছ থেকে প্রতিজন এক লক্ষ টাকা করে আর্থিক অনুদান পেয়ে তারা কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এখন ক্ষুদ্র ব্যবসা বাণিজ্য করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।
বিশ্বস্ত সুত্র মতে, শনিবার ২৩ নভেম্বর আত্মসমর্পণের জন্য মধ্যস্থতাকরীর সেভহোমে আসা অপরাধীদের মধ্যে কূখ্যাত অস্ত্রের শীর্ষ কারিগর জাফর আলম সহ আরো ১২ জন অভিজ্ঞ ও দক্ষ অস্ত্রের কারিগর রয়েছে। অস্ত্র তৈরীর এসব কারিগরের আত্মসমর্পণও বাংলাদেশের জন্য সর্বপ্রথম। যা হবে এদেশের জন্য একটা ইতিহাস। বিশ্বস্ত সুত্র মতে, দেশে এর আগে আর কোনদিন অস্ত্র তৈরীর কারিগর রাষ্ট্রের কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেনি।