মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) হিসাবে গত সোমবার ২ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ পাওয়া মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার (জ্যেষ্ঠ যুগ্মসচিব) রোববার ৮ সেপ্টেম্বর পূর্বাহ্নে কক্সবাজার নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। মোটেল সড়কস্থ (বিজয় স্বরণী) তে অবস্থিত শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে অতিরিক্ত আরআরআরসি মিজানুর রহমান থেকে নতুন আরআরআরসি মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার দায়িত্ব বুঝে নেন। বিষয়টি তিনি সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত শনিবার ৭ আগষ্ট বিকেলে তিনি বিমানযোগে কক্সবাজার পৌঁছান। আরআরআরসি মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার বৃহস্পতিবার ৫ আগষ্ট দুর্যোগ ও ত্রান মন্ত্রণালয়ে অফিসিয়ালি যোগদান করেন। একইভাবে বিদায়ী আরআরআরসি মোহাম্মদ আবুল কালাম এনডিসি (অতিরিক্ত সচিব) একইদিন পূর্বাহ্নে মন্ত্রনালয়ে গিয়ে আরআরআরসি’র দায়িত্ব থেকে রিলিজ হন বলে তিনিও সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন। বিদায়ী আরআরআরসি মোহাম্মদ আবুল কালাম এনডিসি (অতিরিক্ত সচিব) কক্সবাজার কর্মস্থল ত্যাগের আগে জ্যেষ্ঠ এডিশনাল আরআরআরসি মিজানুর রহমানের কাছে তাঁর দায়িত্বভার অর্পন করেন।
নতুন আরআরআরসি মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার এর আগে দুর্যোগ ও ত্রান মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজ কর্মস্থলে দায়িত্ব নিয়ে মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার নিজ অফিসে সবার সাথে কুশল ও মতবিনিময় করেন। পরে রোহিঙ্গা প্রশাসনের উর্ধ্বতন সকল কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে সার্বিক কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করেন। বৈঠকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরী করে কর্ম সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেন। এসময় তিনি সবাইকে রাষ্ট্রের স্বার্থ ও সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে পেশাদারিত্বের সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের আহবান জানান। প্রসঙ্গত, বিগত সালের নভেম্বর ও চলতি সালের ২২ আগস্ট পূর্ব নির্ধারিত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রত্যাবাসনে কথিত ব্যর্থতা, গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা শরনার্থী আগমনের ২ বছর পূর্তি উপলক্ষে ক্যাম্পের ভিতরে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মহাসমাবেশ করার বিষয়ে শৈথিল্য প্রদর্শনের অভিযোগে বিদায়ী আরআরআরসি মোহাম্মদ আবুল কালাম এনডিসি (অতিরিক্ত সচিব) ও তাঁর প্রশাসন তমুল বিতর্কের মধ্যে পড়েন। এনিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন খোদ সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। এ অবস্থায় বিদায়ী আরআরআরসি মোহাম্মদ আবুল কালাম এনডিসি (অতিরিক্ত সচিব) সহ ৫ জন রোহিঙ্গা প্রশাসনের কর্মকর্তা’কে বদলি করা হয় এবং নতুন আরআরআরসি মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার সহ ৩ জন কর্মকর্তাকে গত ২ সেপ্টেম্বর নতুন করে নিয়োগ দেয়া হয়।
এদিকে, রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রত্যাবাসনে বহুমুখী জটিলতা, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সন্ত্রাসী ও অপরাধ কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়া, দীর্ঘদিন রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে কর্মরত থাকা রোহিঙ্গা প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত বিভিন্ন রোহিঙ্গা সংগঠনের সন্ত্রাসী অপতৎপরতা বৃদ্ধি, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জন্য মোট অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুত ২৫% ভাগ অর্থ ব্যয় করা, রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও এবং আইএনজিও তে স্থানীয়দের চাকুরির ব্যবস্থা করা, এনজিও সমন্বয়কারীর নামে কথিত ক্ষমতাধর একজন আইএনজিও কর্মকর্তাকে খোদ আরআরআরসি কার্যালয়ে অফিস বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ, লাগামহীন এনজিও এবং আইএনজিও গুলোকে রোহিঙ্গা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা, অনুমোদনহীন এনজিও গুলোকে শরনার্থী ক্যাম্প এলাকায় কাজ করতে নাদেওয়া সহ আরো বহুবিদ কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে নতুন নিয়োগ পাওয়া আরআরআরসি মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার ও তাঁর প্রশাসনকে। সমাধানের পথ খুঁজতে হবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে এনজিও এবং আইএনজিও গুলোর দ্বন্দ্ব, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থান সহ দীর্ঘদিন জিইয়ে থাকা অনেক জটিল সমস্যার। রোহিঙ্গা শরনার্থী আগমনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্থানীয় জনগোষ্ঠী, পরিবেশ, অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন প্রশাসনের ভূমিকা কি হবে তাও অনেক ভাবভার বিষয়। এবিষয়ে নতুন নিয়োগ পাওয়া আরআরআরসি মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার সিবিএন-কে বলেন-রাষ্ট্রীয় ভাবে দায়িত্ব যখন দেওয়া হয়েছে, কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হলেও রাষ্ট্রের স্বার্থে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সাথে সেগুলো সমাধান করতে হবে আমাদের সম্মিলিতভাবে। সরকার তাঁকে যে এজেন্ডা দিয়ে কক্সবাজারে আরআরআরসি অফিসের প্রধান করে পাঠিয়েছেন সেসব এজেন্ডা শতভাগ বাস্তবায়ন ও কাজ করতে গিয়ে সৃষ্ট নতুন সংকট ও সমস্যা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক রাষ্ট্রের ইন্টারেস্টকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করে যাবো ইনশাল্লাহ। তিনি বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছরের চাকুরী জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সবার সহযোগিতায় মনোবল, প্রেরণা ও প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি কখনো বিচলিত ও হতাশ হননি। এজন্য তিনি কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সেনাবাহিনী, জনপ্রতিনিধি, বিজিবি, এনজিও, আইএনজিও, সুশীলসমাজ, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, গণমাধ্যম সহ সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করে বলেন, সবাই দেশপ্রেম নিয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থের কথা চিন্তা করলে সহজেই এসব সমস্যার সমাধান করা যাবে ইনশাল্লাহ। তিনি রোহিঙ্গা শরনার্থীর সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত সকলকেই দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে গঠন মূলকভাবে এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।

সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
নতুন শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনার হিসাবে রোববার ৮ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার কর্মস্থলে যোগ দেয়া মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার (৬২৮৪) বাংলাদেশ সরকারের একজন জ্যষ্ঠ যুগ্ম সচিব। বরিশাল গৌরনদী উপজেলার বিল্লো গ্রামের মরহুম মৌলভী আবদুল কাদের তালুকদার এবং মরহুমা নজিবুন্নেছা’র পুত্র মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন। পরে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত ১৫ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে দেশের বুনিয়াদি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ক্যাডার হিসাবে পরিচিত বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের গর্বিত সদস্য হন। ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি প্রথম সরকারি চাকুরীতে যোগদান করেন। চাকুরী জীবনে মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার কুষ্টিয়া সদর উপজেলা ও যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার ইউএনও, ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ঝিনাইদহ ও নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। যুগ্মসচিব হিসাবে পদোন্নতি পাওয়ার পর তিনি দুর্যোগ ও ত্রান মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক (প্রশাসন) হিসাবে সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন সফলতার সাথে। সম্প্রতি মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার’কে বরিশাল বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হিসাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে বদলী করা হয়। সে বদলী আদেশ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার’কে সোমবার ২ সেপ্টেম্বর শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ প্রদান করেন। চাকুরির সহজাত নিয়মে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বদলী হলে তাঁর সহকর্মীরা পুরাতন স্টেশন থেকে বিদায় জানাতে চোখের জল ফেলেছেন সবসময়। কর্মদক্ষতা, ভালবাসা দিয়ে কর্মস্থলের সবাইকে কেমন জানি আপন করে নিয়ে নেন তিনি। মহৎ গুণাবলীর অধিকারী অমায়িক, স্বজ্জন হিসাবে সুনাম রয়েছে তাঁর। একজন দূরদর্শী ও ভাল ব্যবস্থাপক হিসাবে জনপ্রশাসনে তিনি সুপরিচিত। জ্যষ্ঠ যুগ্মসচিব মোঃ মাহবুব আলম তালুকদারের পরিবারে রয়েছে ৪ ভাই, ৪ বোন। ১৯৯৯ সালে মাহবুব আলম তালুকদার উর্মিলা আক্তারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী উর্মিলা আক্তার একজন সুগৃহিণী। মাহবুব-উর্মিলা দম্পতি মারশিদ ও মেহরাব নামক দুই পুত্র সন্তানের গর্বিত জনক ও জননী। জনপ্রশাসনের একজন সৎ, দক্ষ, পরিশ্রমি ও পেশাদার কর্মকর্তা হিসাবে মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিলে তিলে। চাকুরী জীবনের বিভিন্ন সময়ে চ্যালেন্ঞ্জিং বিষয়গুলো তিনি পার করেছেন, নিজের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও পেশাদারিত্ব দিয়ে। মেধাবী এই কর্মকর্তা বিদেশ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। প্রশাসন ব্যাবস্থাপনা বিষয়ে একাধিক দেশ থেকে চৌকস ও মেধাবী কর্মকর্তা মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণও নিয়েছেন।