প্রথম আলো: মা-বাবা, ভাই, স্ত্রীসহ প্রিয়জনদের বন্ধন ছিন্ন করছে ইয়াবায় আসক্ত ব্যক্তিরা। সেবনের টাকা না পেয়ে প্রিয়জনদের গলায় ছুরি চালাতে দ্বিধা করছেন না তাঁরা। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি। ভাঙছে সংসারও। বস্তি থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বনাশা ইয়াবা।

গত ১৪ এপ্রিল থেকে ১৪ মে পর্যন্ত এক মাসে চট্টগ্রাম নগরে ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তিদের হাতে ছয়টি খুনের ঘটনা ঘটে। মাদকের পৃষ্ঠপোষকদের গ্রেপ্তারের দাবিতে নগরের বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন করেছেন ভুক্তভোগীরা। গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের তালিকা দিয়ে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন নগরের কাট্টলীর বাসিন্দারা।

মাদকের উৎস বন্ধ ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

টাকা না পেয়ে পোড়াচ্ছে বাড়িঘর
হাটহাজারীর চিকনদণ্ডী আহনের পাড়ার মো. এমরান মাদকাসক্ত হয়ে চার বছর আগে আসবাব তৈরির কাজ ছেড়ে দেন। ইয়াবা সেবনের টাকার জন্য পরিবার ও প্রতিবেশীদের মারধর করতে থাকেন। দুই দফায় পুলিশ তাঁকে মাদকসহ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। ছয় মাস আগে মুক্তি পান। আবার জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা সেবনে। টাকার জন্য মারধর করায় এক সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী রনি আক্তার বাপের বাড়ি চলে যান। ৪ মে বৃদ্ধা মা রাজুয়ারা বেগমের কাছে আড়াই শ টাকা চান এমরান। না দেওয়ায় ঘরে থাকা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে তাঁদের ঘর, প্রতিবেশী আবদুস সালাম ও আবদুল আজিজের ঘর পুড়ে যায়।

১৩ মে সরেজমিনে দেখা যায়, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঘরের সব জিনিসপত্র। অন্য প্রতিবেশীর বাসায় থাকছেন তাঁরা। রাজুয়ারা বেগম বলেন, ইয়াবা তাঁর সব শেষ করে দিয়েছে। ছেলেকে চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোথায় নিতে হবে জানেন না।

কয়েকটি ঘটনা
কাজীর দেউড়ি এলাকায় গত ১৪ এপ্রিল বাবা রঞ্জন বড়ুয়াকে খুনের মামলায় ছেলে রবিন বড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চাচা সঞ্জয় বড়ুয়া জানান, ছয় বছর ধরে মাদকাসক্ত রবিন টাকার জন্য বাবাকে মারধর করতেন।

মাদকাসক্তদের হাতে চট্টগ্রামে এক মাসে ৬ খুন
ঘরে ঘরে আতঙ্ক, এলাকাবাসীর মানববন্ধন
মাদকের উৎস বন্ধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদ

মাদক মানে বিষমাদক মানে বিষছোট ভাই মুন্না বড় ভাইয়ের কাছে ১০টি ইয়াবা রাখেন। ফেরত চাইলে সেবন করার কথা জানান বড় ভাই সাজু। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে খুন হন সাজু। গত ১৭ এপ্রিল নগরের চান্দগাঁও কমরপাড়ার ঘটনা এটি।

কাট্টলীর কালীবাড়ি এলাকায় ১০ মে রাত ১০টার দিকে মাদকাসক্ত যুবক সত্যজিৎ ঘোষের এলোপাতাড়ি দায়ের কোপে সন্ধ্যা রানী নামের তাঁর এক প্রতিবেশী নিহত হন। এ ছাড়া আহত শান্তি নন্দী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার মারা যান।

বাকলিয়া বলিরহাট এলাকায় ১১ মে রাতে বাসায় ঢুকে বুবলি আক্তার নামের এক নারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ভাই মো. রুবেলকে না পেয়ে তাঁকে মারা হয়। ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে রাখতে শাহ আলম নামের এক মাদক ব্যবসায়ী ওই কাণ্ড ঘটান। ওই দিন রাতেই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান তিনি।

বাসায় ঢুকে ইয়াবা সেবনের টাকা না পেয়ে মো. সোহেল নামের এক ব্যক্তি ২ মে নগরের কোরবানিগঞ্জে মামি রোকসানা আক্তারকে ছুরিকাঘাতে খুন করেন। রোকসানা খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী আবুল কাশেমের স্ত্রী।

ফাঁকা নিরাময়কেন্দ্র
১৩ মে দুপুরে নগরের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে অবস্থিত মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় বেশির ভাগ সিট খালি পড়ে আছে। ২৫ শয্যার চট্টগ্রাম বিভাগীয় মাদকাসক্ত এই নিরাময়কেন্দ্রে রোগী আছেন মাত্র সাতজন। সবাই ইয়াবায় আসক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী জানালেন, টাকা ছাড়াই যেকোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তি এখানে থেকে চিকিৎসা নিতে পারেন।

সমাধান কোথায়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু প্রথম আলোকে বলেন, মাদকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক, দেশীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মাদকের উৎস ও বিপণনে রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে। যাঁরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁদের মাদকাসক্ত নিরাময়কেন্দ্রে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে হবে।

মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে জানিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, ইয়াবা যাতে দেশে ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে কি না।