– মাসরুর আলম চৌধুরী

আমাদের দেশে মেধা এবং অর্জনের মানদন্ডটা পশ্চিমা দেশগুলোর থেকে একটু ভিন্ন । নামের পাশে কোন খেতাব না আসা পর্যন্ত আমরা কাউকে ঠিক মেধাবী বলে স্বীকার করি না। ঠিক একই ভাবে গতানুগতিক পেশাগুলো বাদে অন্য পেশার মানুষগুলোকে আমরা যথাযথ মর্যাদাও দিতে চাই না। অথচ দেশের বাইরে দেশের নামটি তারাই গৌরবের সাথে তুলে ধরছেন, জানিয়ে দিচ্ছেন বিশ্বকে পিছিয়ে থাকবে না বাংলাদেশ।

ফ্লান্সে অনুষ্ঠিতব্য ৭২ তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের শর্টফিল্ম কর্ণারে স্থান পেয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘যুদ্ধটা ছিল স্বাধীনতার’। চলচ্চিত্রটির ইংরেজি নাম দ্যা আনসাং, মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত পরিচালক আশরাফ শিশির এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন কক্সবাজারের সন্তান রাফায়েত নেওয়াজ কচি। ৩০ মিনিট ব্যাপ্তির এই চলচ্চিত্রটি সম্প্রতি বাংলাদেশ ফিল্ম সেনসর বোর্ড থেকে প্রদর্শনের সনদ পেয়েছে।

সাগরপাড়ের শহর কক্সবাজারে বেড়ে উঠা ছেলেটি হয়ত শতবার নিজেকে তিরস্কার করেছে সংগীতকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার জন্য। নতুন বাহারছড়া (এয়ারর্পোর্ট রোড) নিবাসী আইনজীবী ও সংগীত অনুরাগী বাবা সেলিম নেওয়াজের এবং মা রহিমা নেওয়াজ বেবির একমাত্র পুত্র সন্তান রাফায়েত নেওয়াজ কচির ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ঝোঁক । বাবার ইচ্ছায় সংগীতের তালিম নেন। নজরুল, লালন, রবীন্দ্র সংগীতের পাশাপাশি পাশ্চাত্য সংগীতও তাকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করে। সংগীতকেই জীবনের লক্ষ্য, পেশা হিসেবে স্থির করে নিজের সবটুকু সময়, শ্রম, মেধা এবং আবেগ উৎসর্গ করে দেয় সংগীতের জন্য । এজন্য ভৎসনাও কম সহ্য করতে হয়নি আশপাশের মানুষের । তবে বরাবরই বাবা-মার উৎসাহ এবং সহযোগীতা পেয়ে এসেছেন।

স্কুলে থাকাকালীন আর্মাগেডেন নামে স্থানীয় একটি ব্যান্ডের কী বোর্ডিস্ট এবং ভোকাল (গায়ক) হিসেবে কাজ করেছেন। কক্সবাজার কেজি স্কুল থেকে এস.এস.সি এবং কক্সবাজার সিটি কলেজ থেকে এইচএসসির পর ২০০৯ সালে ঢাকায় আসেন নিজের সংগীত জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে একজন সফল সংগীত শিল্পী হওয়ার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে। যোগ দেন হেভি মেটাল ব্যান্ড হ্যাডোনিজমে। একই সাথে গিটারিস্ট কীবোর্ডিস্ট এবং ভোকাল (২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্যান্ডটির। ডেডলাইন মিউজিকের প্রযোজনায় ২০০৯ সালেই ‘প্রলয়’ শিরোনামে একটি মিক্সড ব্যান্ড এ্যালবামে মুক্তি পায় তাদের গান ‘অভিশাপ’। পরবর্তীতে নিজেকে স্বতন্ত্র সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যান্ড ছেড়ে একক কাজ শুরু করেন।

রাফায়েত  যুক্ত হন চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্পে। ২০১৮ সালে তারই সংগীত পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘গাড়িওয়ালা’, এবং সিনেমাটিতে অভিনয় করেন রোকেয়া প্রাচী, রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং মাসুম আজিজের মত খ্যাতিমান অভিনেতারা। এছাড়াও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের সাবেক প্রভাষক তামিম জামশেদ নির্মিত আয়ারল্যান্ডে ধারণকৃত মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘আফটার ডেথ’ -এর আবহ সংগীত করেন রাফায়েত নেওয়াজ কচি। তার উল্লেখ্যযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে ‘গোপন-দ্য ইনার সাউন্ড’ থ্রিলারধর্মী পুর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি দিল্লি, মস্কোসহ ১৪ টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং অর্জন করে বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে নির্মিত ২১ ঘন্টার চলচ্চিত্র ‘আমরা একটি সিনেমা বানাব’- এর সংগীত পরিচালনা করেন কচি। চলচ্চিত্রটি আটটি অধ্যায়ে ভাগ করে প্রতিটি অধ্যায় আলাদা ভাবে মুক্তি দেওয়া হবে এবং প্রতিটি অধ্যায়ের সম্পর্কিত পরিণতি থাকবে বলে জানান পরিচালক আশরাফ শিশির।

২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পূনর্মিলনের প্রাক্কালে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের প্রামাণ্য চিত্রের সম্পূর্ন আবহ সংগীতও তারই করা। অথচ অবাক করা বিষয়টি হল দরিয়া নগরীর সন্তান প্রচার বিমুখ এই তরুন সংগীত নির্মাতার নামও হয়তো শুনেনি কক্সবাজারের বেশিরভাগ মানুষ। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসনে তটস্থ আমরা যদি পশ্চিমাদের মত মেধার মূল্যায়ন করতে শিখি তাহলে হয়তো অপমৃত্যু হবে না কোন মেধার। আমরাই হয়ত সৃষ্টি করতে পারব একজন মরিকনি, হ্যানজিমার বা এ.আর. রহমান।


Written by – Masrur Alam Chowdhury